ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১

দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের গতি ও শক্তি

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:৩০, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের গতি ও শক্তি

ডোনাল্ড ট্রাম্প

গত ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল রোটুন্ডায় শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর এ অভিষেক বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মোড় আনতে যাচ্ছে। শপথ গ্রহণের পর ওভাল অফিসে ফিরে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী আদেশে সই করেন। শুরুতেই তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলের ৭৮টি নির্বাহী আদেশ বাতিল করেন। এর আগে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ওয়ান অ্যারেনার মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রদত্ত প্রথম ভাষণে ট্রাম্প বলেছিলেন, শীঘ্রই বাইডেন আমলের ৭৮টি নির্বাহী আদেশ তিনি বাতিল করবেন। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে দখলদার ইসরাইলিদের ওপর প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নির্বাহী আদেশ জারি করেন। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যকার ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং বিপুল প্রাণহানি থেমেছে সম্প্রতি সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে। টামইস অব ইসরাইল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শীঘ্রই মধ্যপ্রাচ্য সফরের পরিকল্পনা করেছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক পুনরায় চালু রাখতে আদেশ জারি করেন। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণাসহ একাধিক আদেশে সই করেন তিনি। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে ট্রাম্প সমালোচনা করেছিলেন। তখন থেকেই তিনি এ প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সে সিদ্বান্ত বাতিল করেন। এই নির্বাহী আদেশটি যেহেতু ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিনেই স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাই এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে দেশটির বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। পানামা খাল আবারও ফিরিয়ে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এ দফায় ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমেরিকার স্বর্ণযুগে পা দিয়েছে বলেও তিনি প্রদত্ত ভাষণে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমেরিকার স্বর্ণযুগ এখান থেকে শুরু হলো। ট্রাম্প বলেন, এখন থেকে সামনের দিনগুলোয় আমাদের দেশ আরও সমৃদ্ধ আর সম্মানজনক অবস্থানে উঠে আসবে। আমার একমাত্র লক্ষ্য হবে, আমেরিকাকে প্রথমে রাখা। প্রদত্ত ভাষণে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, আমাদের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা হবে, আমাদের নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করা হবে, পুনরায় ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনা হবে। আমরা একটি গর্বিত, সমৃদ্ধিশালী ও স্বাধীন জাতি তৈরি করার লক্ষ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও ধনী রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে বলে তিনি ভাষণে উল্লেখ করেন। তাঁর ভাষণের মূল বিষয় ছিল ঐক্য, শক্তি এবং ন্যায়বিচার। সমর্থকদের তিনি বলেছেন, শপথ নেওয়ার পরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ঐতিহাসিক গতি এবং শক্তি নিয়ে কাজ করবেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নত করা, সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি বিভাগ গঠন করা, জন এফ কেনেডির হত্যা সম্পর্কিত রেকর্ড প্রকাশ করা, সামরিক বাহিনীকে আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির নির্দেশনা প্রদান এবং সেনাবাহিনী থেকে বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি নীতি বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিশ্বনেতারা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তাঁর সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগের কথা বলেন। ২০ জানুয়ারি রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলে প্রদত্ত এক ভাষণে পুতিন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে তিনি আগ্রহী। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করার কথা জানিয়েছেন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নতুন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্ত করতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার জন্য নেতানিয়াহু ধন্যবাদ জানিয়েছেন। একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তিনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে বলে জানান। এছাড়া নতুন মার্কিন প্রেসেিডন্টকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুলা দা সিলভা, সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসনসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। শপথ গ্রহণের পূর্বেই ট্রাম্প প্রশাসন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০ জন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়েছে। ‘ডিপ স্টেট’ ভাঙতে তাদের সরে যেতে বলা হয়েছে। মূলত পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজাতেই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে কাজ করা জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে ট্রাম্প প্রশাসন সরে যেতে বলেছে। তাদের স্থলে অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আগের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। এতে করে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি আরও কার্যকর ও শক্তিশালী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ট্রাম্পের গৃহীত এসব উদ্যোগের কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।
ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে তিনি অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে যে লাখ লাখ অপরাধী অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে, যেখান থেকে তারা এসেছে, সেখানে তাদের ফেরত পাঠানোর হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করেই তিনি জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বাতিল করে নির্বাহী এক আদেশে সই করেছেন। তিনি বলেন, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি একেবারে হাস্যকর এবং তার বিশ্বাস এই বিধান পরিবর্তনের জন্য ভালো আইনগত যুক্তি রয়েছে। আদেশে স্বাক্ষর করার সময় ট্রাম্প অবশ্য স্বীকার করেছেন, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার যেহেতু দেশের প্রচলিত সংবিধানে নিশ্চত করা আছে, এই কারণে তার এই আদেশ আইনগত চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে পারে। ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অবৈধভাবে বা শিক্ষা ও পর্যটনসহ সাময়িক ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসে সন্তান জন্ম দিলে সেই শিশু মার্কিন নাগরিকত্ব পাবে না। তবে মা-বাবার কেউ আমেরিকান নাগরিক হলে সন্তান জন্মের পরই মার্কিন নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে গৃহীত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার নির্বাহী চুক্তিতে ট্রাম্প সই করেছেন। এই নির্বাহী আদেশে সইয়ের মাধ্যমে গত এক দশকের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্বন নির্গমনকারী দেশটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে সরকারগুলো বৈশি^ক উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিল, ট্রাম্প এর সমালোচনা করে আসছেন।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে হামলা চালিয়েছিল ট্রাম্পের সমর্থকরা। ট্রাম্পপন্থি বিক্ষোভকারীদের কংগ্রেস ভবনে ওই হামলায় অন্তত ৫০০ জন নিহত হয়েছিলেন। ডেমক্র্যাটরা ওই হামলায় উসকানি দেওয়ার জন্য ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। পরে সিনেটের দুই তৃতীয়াংশ ভোট না থাকায় শাস্তি থেকে রেহাই পেয়েছিলেন ট্রাম্প। দাঙ্গায় যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় ১,৬০০ মানুষকে ক্ষমা করেছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পোৎপাদন খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি হিসেবে আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্কারোপের আশ্বাস দিয়েছেন ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে চীনসহ বিভিন্ন দেশের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করেছিলেন তিনি। এবার তিনি সকল ধরনের আমদানি পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্কারোপের আশ্বাস দিয়েছেন। এর মধ্যে কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনের পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হতে পারে। এসব শল্ক ভোগ্যপণ্যকে আরও ব্যয়বহুল করতে পারে এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি করতে পারে। ট্রাম্প তাঁর প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমেরিকান ও তাইওয়ানি কূটনীতিকদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিলেন; যা চীনের ক্ষোভের কারণ ছিল। কার্নেগি এন্ডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো টং ঝাও বলেন, বেজিং বিশেষভাবে এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, ট্রাম্পের আমলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ আবারও শুরু হতে পারে। চীন মনে করে, ট্রাম্প প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে চীনকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন; যা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে এবং এর ফলে দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। এ প্রতিক্রিয়ায় চীন আরও বেশি প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বতন্ত্রতার জন্য চেষ্টা বৃদ্ধি করবে এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার চাপ অনুভব করবে বলে তিনি মনে করেন। ট্রাম্প সব সময় ক্রিপ্টোকারেন্সি নীতির পক্ষে ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিটকয়েনের দাম ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্প বিটকয়েনের একটি কেন্দ্রীয় মজুত গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ নেবেন। এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের জ¦ালানি তেল ও সোনার একটি কৌশলগত মজুত। মার্কিনিদের উপকারে এটি স্থায়ী জাতীয় সম্পদ হিসেবে কাজে লাগবে বলে ট্রাম্প মনে করেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা’ দেশের তালিকা থেকে কিউবার নাম সরিয়ে দিয়েছেন বাইডেন। ট্রাম্প নির্বাহী আদেশ জারি করে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারেন। তিনি ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করতে পারেন। ট্রাম্প ‘মেক্সিকো সিটি নীতি’ পুনর্বহাল করবেন বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে গর্ভপাতবিষয়ক পরামর্শ সেবাদাতা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোকে কেন্দ্রীয় সহায়তা দেওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তিনি একটি গর্ভপাতবিষয়ক বিধিও পুনর্বহাল করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের দিনেই নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিওকে চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রদান করেছে দেশটির সিনেট। এর মধ্য দিয়ে এই প্রথম লাতিনো বংশোদ্ভূত কোনো রাজনীতিক যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি সর্বসম্মতভাবে ৯৯-০ ভোট পেয়ে এ পদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই রাজনীতিবিদ যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র চীন, রাশিয়া, ইরান ও কিউবার বিষয়ে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক। এছাড়া তিনি কট্টর ইসরাইলপন্থি হিসেবে পরিচিত। ট্রাম্প সবসময়ই পূর্বের প্রেসিডেন্টের অকার্যকর ও ব্যয়বহুল যুদ্ধ জড়িয়ে পড়ার সমালোচনা করতেন। ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন মার্কো রুবিও। দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যাপক প্রভাব পড়ার শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিতে ক্ষতির মুখে পতিত হয়েছে লাখ লাখ অভিবাসী। এর মধ্যে বাংলাদেশী অভিবাসীও রয়েছেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের নেতৃত্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্র দূরে সরে যাবে বলে মন্তব্য করেন বিশ্লেষকরা। এতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আর্থিক সহায়তায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কূটনীতিকরা মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্কের ওপরই মূলত বাংলাদেশের হিসাব-নিকাশ নির্ভর করবে। অবৈধ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ঘোষিত যুদ্ধের আঁচ দেশটিতে বসবাসরত কাগজপত্রবিহীন বাংলাদেশীদের ওপরও লাগবে। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশনস বিভাগের চেয়ারপারসন ড. মো. আবু নাসের মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মৌলিক কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। যে পরিবর্তনটা হতে পারে, সেটা হলো যে বাইডেনের সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হলেও ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের ফোকাস এরিয়াতে হয়তো গণতন্ত্র ও মানবাধিকার তেমন গুরুত্ব পাবে না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না করলে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হবে রাশিয়া। ক্ষমতা গ্রহণ করেই বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বন্ধ করার আশ্বাস দেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন। অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করা, বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি স্কিমে কাজ করা সকল মার্কিন সরকারি কর্মকর্তাদের তিনি দ্রুত ছুটি দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। ট্রাম্পের দাবি, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মেধার ভিত্তিতে তৈরি যুক্তরাষ্ট্র গড়ার পথে এই সংস্থাগুলো বাধাস্বরূপ। ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই সংস্থাগুলোতে ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি, তাদের ওয়েবসাইটগুলো তিনি বন্ধের নির্দেশ দেন। ক্ষমতায় আসার পূর্বেই লেবানন ও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধের পর এবার তার লক্ষ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা। এই লক্ষ্যে রুশ প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে তিনি একের পর এক হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন। ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ না করলে রাশিয়ার ওপর উচ্চমাত্রায় শুল্ক, কর ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। অভিবাসন নীতি নিয়ে কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও নেমেছেন তিনি। বিজয় সমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্যে ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এসেই অবৈধ অভিবাসীদের তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিবেন এবং সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। এরই ধারাবাহিকতায়, প্রায় ১০০০ সৈন্যকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্তে মোতায়েনের পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। একইসঙ্গে ‘দ্রুত অপসারণ’ নীতি বাস্তবায়ন করেছেন। যে নীতি অনুযায়ী, কোনো অভিবাসী যদি প্রমাণ করতে না পারে যে তারা দুই বা তার বেশি বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছে, তবে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এদিকে অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লিভিট বলেন, মার্কিন কর্তৃপক্ষ ৫৩৮ জন অবৈধ অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং সামরিক বিমান ব্যবহার করে কয়েকশ’ জনকে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন সামরিক বিমানের মাধ্যমে শত শত অবৈধ অভিবাসী অপরাধীকে বহিষ্কার করেছে। এছাড়া ইতিহাসের বৃহত্তম নির্বাসন প্রক্রিয়া চলছে। যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত সুরক্ষিত করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন যেসব কাজ করছে, এই ঘটনা তার একটি ছোট নমুনা।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×