ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১

দ্রোহের চেতনায় জাগ্রত মহান ফেব্রুয়ারি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:২৩, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

দ্রোহের চেতনায় জাগ্রত মহান ফেব্রুয়ারি

বাঙালির সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনায় যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য; তা হলো নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলার সবুজ অবগাহন। এই বাংলার রূপ দেখার জন্য গভীর উপলব্ধি প্রয়োজন। চিন্তা-চেতনা ও ভাবনার প্রকৃতি আবিষ্কারে যেমন বিকশিত অন্তর অপরিহার্য, তেমনি স্বজাত্যবোধ ধারণ করার জন্য মাতৃভাষার অবদানও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মূলত মাতৃভাষায় আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সকলের উপস্থাপন সে ভাষার জনগোষ্ঠীর মাঝে অনবদ্য আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের বিশাল অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। সকল কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক এবং সচেতন মহলে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচর্যার প্রধান বাহন হচ্ছে মাতৃভাষা। কবি জীবনানন্দ দাশ যদি মাতৃভাষা বাংলায় ‘রূপসী বাংলা’ প্রকাশ না করতেন; তা হলে বাংলাকে এত সুন্দর করে দেখার তৃতীয় নয়ন কখনো কার্যকর হতো না। ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও/আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব/দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে/ভোরের বাতাসে/দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের/সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে/ধবল লোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং/ঘাসে অন্ধকারে নেচে চলে/একবার-দুইবার-তারপর/হঠাৎ তাহারে বনের হিজল গাছ/ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে...’। এমন অপরূপ দ্যোতনা অন্য কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় কি না আমার বোধগম্য নয়।
ভাষাভিত্তিক একটি জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে হাজার বছরেরও বহু আগে। পরিবর্তনের বিভিন্ন ধারায় ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান ভাষার মতো প্রায় দশম শতক থেকেই বাংলা ভাষার ইতিহাস ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ। যে কোনো সমাজে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারে ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ভাষাকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর সুদীর্ঘকালের ঐক্যের বন্ধন ও জাগতিক সকল অনুভূতির যে সামগ্রিক প্রকাশের সাধারণ, সার্বজনীন ও সৃজনশীলতার সমষ্টিগত রূপের আবর্তন ঘটে, এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। তবে এটিও সত্য যে, ভাষার অনৈক্য সত্ত্বেও পৃথিবীতে বহুজাতি বিদ্যমান। যেমন সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীরা তিনটি ভাষায় কথা বলেন। অন্যদিকে একই ইংরেজি ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ ও মার্কিনরা ভিন্ন জাতি। সর্বজনস্বীকৃত বিষয় হচ্ছে এই, মানব সংস্কৃতির পার্থিব রূপ তথা বস্তুর সৃষ্টির পেছনে অপার্থিব ধ্যান-ধারণা বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ফসলই সভ্যতার সোপান নির্মাণ করেছে। এক কথায় অনেকের মতে মানুষের বিমূর্ত চিন্তার ফসলই হচ্ছে সভ্যতা।
বস্তুতপক্ষে অবস্তুগত সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ হিসেবে ভাষা মানুষের মনোজগতের ভাব-কল্পনা, সাহিত্য-শিল্পকলা ইত্যাকার সকল অপার্থিব ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক রূপে চিহ্নিত হয়েছে। যেহেতু অন্য কোনো প্রাণীর ভাষা নেই, তাদের সংস্কৃতিও নেই। একমাত্র ভাষার কারণে মানুষ সংস্কৃতিবান হতে পেরেছে। মনীষীদের মতে, এ উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এ উপমহাদেশে  দ্বিতীয় নবজাগৃতির সূচনা করেছে। পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে  ১৩০০-১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর্যায়কে যেমন জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, কলা প্রভৃতি  ক্ষেত্রে  এক  অভূতপূর্ব নবজাগরণের বা  মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উন্নীত হওয়ার যুগ হিসেবে ধরা হয়, তেমনি বাংলাদেশেও মূলত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র শহীদের মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে আত্মানুসন্ধানের যাত্রাকেও নবজাগরণের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
আমরা সম্যক অবগত যে, বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘকালব্যাপী যে স্বাধিকার আন্দোলন বা মুক্তিসংগ্রাম ও এর  চূড়ান্ত পরিণতিতে সংঘটিত  মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন সার্বভোম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গৌরবোজ্জ্বল পটভূমি হচ্ছে এ মহান ভাষা আন্দোলন। পৃথিবীতে বাঙালিই একমাত্র জাতি যাঁরা রক্তের বিনিময়ে তাঁদের ভাষার অধিকার নিশ্চিত করেছেন। এ জন্যই একুশে ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। একুশের ফসল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ অশ্রুতপূর্ব সুর, আবেগ ও বেদনা মিশ্রিত এ গানটিই ছিল ফরাসি বিপ্লবের অভূতপূর্ব সৃষ্ট স্বাধীনতা ও সাম্যের গানের মতোই আমাদের স্বাধীনতা-মুক্তি-চেতনার অনন্য প্রধান বাহন। এটি ছিল দেশ ও জাতির সকল দীপ্ত জাতীয়তার অহংকার এবং অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দ্রোহী চৈতন্যভরা প্রতিবাদের মূল শক্তি। সকল তুচ্ছ ভয়, যন্ত্রণা-কাতর জীবনবোধকে জয় করে আলোকিত অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার তীব্র তাগিদ ও অঙ্গীকার একুশের ভাবমূর্তিকে করেছে সুস্পষ্ট এবং উজ্জ্বল।
আত্ম-পরিচয় ও প্রগতির পথে পদচারণার তাগিদে একুশের আগুনছোঁয়া স্মরণ বরাবরই এ জাতিকে করে উদ্বেলিত ও উজ্জীবিত। এরই আলোকে একুশ শুধু বেদনার স্মৃতিগাথা না হয়ে মুক্তির গৌরবগাথা হিসেবে এ জাতির জীবন সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হয়ে গেছে। একুশকে ঘিরে বইমেলা, সংগীত উৎসব, চিত্রাঙ্কন, কবিতা, ছড়া, সাহিত্য ইত্যাদি নবরূপে আবির্ভূত হয় প্রতিটি বছর এ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। নতুন চিন্তা-চেতনায়, মুক্তির নতুন ধারণায়, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নতুন রচনায় এসব কর্মকাণ্ড একুশ মেলা নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সনাতন কোনো বিনোদনমূলক ব্যবস্থা নয়, বরং মননশীল, সুস্থ,  শাশ্বত ও সাবলীল সংস্কৃতির অবগাহনে স্নিগ্ধ করে সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও মানবিক জীবনবোধের উদ্দীপ্ত বাসনায় প্রাণিত করে একুশের মেলা সকল স্তর, বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চল নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতিকে। যদিও একুশের বইমেলার শুরুটি ছিল বড় করুণ, বড় একা, কালক্রমে স্ফুলিঙ্গের মতো দিগি¦দিক ছড়িয়ে এর বহুমাত্রিকতা পেয়েছে এক অভিনব বিশালতা।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল, তার পেছনে প্রধান রাজনৈতিক যুক্তিটি ছিল, যে তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬% মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। যার বিপরীতে ৬.১% ছিল পাঞ্জাবিভাষী, ২৭.১% পশতুভাষী, ৪.৮% সিন্ধিভাষী, ১.৪% ইংরেজিভাষী। তখন উত্তর ভারত থেকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত মাত্র ৬% জনগণের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সকল উপাদানের যে মূল ভিত্তি তথা বাংলা ভাষাকে চরম অবহেলা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে উদ্যোগ সে সময়কার শাসকদের মধ্যে কাজ করেছিল, তা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং গভীর ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ। প্রায় ৫৫% জনগণের সামগ্রিক উন্নয়ন যে ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল এবং এটি যে এই অঞ্চলকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, এই উপলব্ধি থেকেই পশ্চিমা শাসকরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষাকে পদদলিত করার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।
বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার যে প্রবণতা তা যে শুধু ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান শাসিত অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক যুগে সম্প্রসারিত হয়েছিল, তা নয়। এর বহু আগে থেকে বিশেষ করে তুর্কি শাসনের সময় থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। সে জন্য মধ্যযুগে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে স্বশাসনে প্রতিষ্ঠাকল্পে কবি আব্দুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণি’ শীর্ষক এক কবিতায় লিখেছেনÑ ‘সে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণি, সে সব কাহার জনম নির্ণয় ন জানি।’ এটি যে শুধু একটি ব্যঙ্গ্যার্থক কথোপকথন বা কোনো রচনার পঙ্ক্তি ছিল তা নয়, তা ছিল এই অপশাসন এবং বাংলা ভাষা অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের প্রকাশ।
ভারত উপমহাদেশে বঙ্গভঙ্গ এবং পরবর্তীতে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলার রোষানলে বাঙালির ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির মৌলিক বাহন ভাষাকেই  সর্বপ্রথম আঘাত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায় ‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর’ অনুপম প্রাণশক্তিতে ঋদ্ধ বাঙালি পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও নতুন করে বঞ্চনার বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি গোড়া থেকেই অনুভব করতে পেরেছিলেন। সকল শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ বাঙালি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রচণ্ড প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আদায়ে মরণপণ ব্রত গ্রহণ করে। ফলে, রক্তক্ষরণ-জীবন বিসর্জনের নতুন অধ্যায় রচিত হয় ১৯৫২ সালের একুশে  ফেব্রুয়ারি।
গভীর দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করতে হয় শহীদ বরকত-রফিক-জব্বার ও সালামের মতো বিপুল সংখ্যক শহীদানের জীবনের বিনিময়। বিশ্বে বিরল ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অবিনাশী পটভূমি তৈরিতে এসব শহীদানের অবদান অবিস্মরণীয়। মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মহান ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি মাস এ কারণেই শোক ও শক্তির অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়ে ঐতিহ্যিক দিক থেকে মহিমান্বিত। আজ এই গৌরবদীপ্ত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিনেই বিনম্রচিত্তে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও একই সঙ্গে জুলাই ২৪-এর সকল শহীদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।  

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

×