ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

সড়কের যানজট এক আতঙ্কের নাম

জান্নাতুল মাওয়া (রিফাত)

প্রকাশিত: ২০:২৩, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

সড়কের যানজট এক আতঙ্কের নাম

শহরের বুকে নিত্যদিনের দুর্ভোগ হিসেবে বেশ পরিচিত এক সমস্যার নামসড়কের যানজট যা বর্তমানে মহামারি আকার ধারণ করেছে। অল্প পথ অতিক্রমের জন্য হলেও ঘন্টার পর ঘণ্টা সড়কের যানজট পাড়ি দিয়ে তারপর গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হয়। মুহূর্তেই জীবনের মূল্যবান সময়কে স্তব্ধ করে ফেলে যানজট। যার প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ কর্মস্থল এবং অর্থনৈতিক খাতগুলোতে। প্রতিনিয়ত এই যানজটের স্বীকার হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। যারাই তাদের ব্যস্ততম জীবনের কর্মকাÐ সম্পাদনের জন্য সড়কে নেমে আসছে তারাই সড়কের যানজটের গোলোক ধাঁধাঁয় আটকে পড়ে মূল্যবান সময়কে ধ্বংস হতে দেখে। সড়কে যানজট সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম প্রধান দুটি কারণ হলো ওভারটেকিং রাস্তা সংস্করণের অভাব। ওভারটেকিংয়ের ফলে সড়ক মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর যেকোনো স্থানে গাড়ি, বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। ফলে তা সড়কের জন্য যেমন যানজটের সৃষ্টি করে তেমনি সাধারণ মানুষের জীবনের ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে। সড়কের যানজট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, সড়ক সংস্কারের অভাব। সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় খাদ, পানিপূর্ণ রাস্তা, ভাঙাচুরা পিচঢালা হওয়ার ফলে চালকেরা সতর্কতার সঙ্গে পথ অতিক্রমে ব্যর্থ হয়। পথে যানবাহন চালানো যেমন জন্য বিপজ্জনক হয়ে তেমনি ভারসাম্য বজায় রাখাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সড়কগুলোতে প্রায়শই যানজট লেগেই থাকে এবং সড়কগুলো প্রতিনিয়তই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সাক্ষী হতে থাক। যা সাধারণ জনগণের জন্য চরম দুর্ভোগের পাশাপাশি বিষাদ ভরা জীবনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল (NSC) এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সড়কের অবস্থা সরাসরি দুর্ঘটনার ১০-১৫% ক্ষেত্রে দায়ী। এছাড়াও বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোতেও অসংখ্য অপ্রশস্ত শাখা-প্রশাখাযুক্ত রাস্তাঘাট রয়েছে যা সঠিক পরিকল্পনার অভাবে গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে তাই যানজটের কারণ হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই সরুপথ দ্বারা ট্রাকও অন্যান্য ভারী যানবাহনের প্রবেশ সম্বব হয়ে না বা প্রবেশ করলেও তা একমুখী সড়কের মিকা পালন করে। ফলে যানজট ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকে। তাছাড়া অবৈধভাবে হকারসহ অন্যান্য দোকানদার কর্তৃক ফুটপাত দখলের ফলে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। পথচারীরা চলাচলের জন্য সড়ক ব্যবহার করে। এতে রাস্তায় যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পায়। যাতায়াতের জন্য পথচারীদের সড়ক  ব্যবহার তাদের জীবনের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং কারণেই বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন উচ্চমাত্রায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে ওভারব্রিজের অভাব, উন্নত প্রযুক্তির যানবাহন, অসচেতন চালকদের নিয়ম না মানা, ট্রাফিক সিগন্যাল অকার্যকর করা এবং পথচারীদের অসচেতনতা রাস্তার যানজটকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলে। এই যানজট বৃদ্ধির ফলে সকল সেক্টরের মানুষ তাদের কর্মস্থলে যথাসময়ে পৌঁছতে পারে না। এমনকি শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত তাদের পাঠ গ্রহণের উদ্দেশ্যে যথাসময়ে স্কুলে উপস্থিত হতে পারছে না। গুরুত্বপূর্ণ কর্মস্থলগুলোতে যথাসময়ে উপস্থিত না হওয়ার ফলে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে যা অর্থনৈতিক খাতকে অচল করে তুলছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (BUET) এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতি বছর প্রায় - বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৭,০০০-২৫,০০০ কোটি টাকা) ক্ষতি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে ঢাকা শহরে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। এটি শুধু অর্থনৈতিক খাতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না, এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকার ফলে মানুষের মানসিক চাপ, অস্থিরতা ক্লান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা তাদের মানসিক শারীরিক কর্মক্ষমতাকে কমিয়ে ফেলছে। দীর্ঘ সময় ধরে যানজটে আটকে থাকার ফলে গাড়ি থেকে নির্গত দূষিত ধোঁয়া বায়ুর সঙ্গে মিশে গিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। যা মানুষের শরীরে শ্বাসজনিত রোগেসহ নানান ধরনের রোগের জন্ম দিচ্ছে। যানজটের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে অ্যাম্বুলেন্স বা জরুরি সেবার যানবাহনগুলো ক্ষেত্রে। অ্যাম্বুলেন্স বা জরুরি সেবার যানবাহনগুলো যানজটে আটকে যাওয়ার কারণে অনেকের মূল্যবান জীবন পথে ঝরে যাচ্ছে। যানজটের ফলে সমাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হচ্ছে অসুস্থ মুমূর্ষ রোগীরা। যানজট নিরসনের মাধ্যমে সমাজকে সুস্থ স্বাভাবিক নিয়মে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। জন্য যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। অত্যাধুনিক যানবাহনের ব্যবহার চালু করতে হবে। ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে রাস্তার যানজট কিছুটা নিরসন করা সম্ভব হবে। অফিস টাইম স্কুল টাইমে পার্থক্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী মানুষদের রাস্তা যানবাহনে ধকল কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে। এর ফলে রাস্তায় যানবাহনের চাপ কম থাকবে এবং যানজটের নিরসন ঘটবে। এছাড়াও প্রতি অঞ্চলে বসবাসকারীদের তাদের অঞ্চলেই কর্মক্ষেত্র শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের প্রতিদিন একই স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার দুর্ভোগ কমে যাবে। ফলে রাস্তার অধিকাংশ যানজটই নিরসন হবে। এভাবে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে মুক্ত করা যাবে এবং অসুস্থ রোগীদের মূল্যবান জীবনও বাঁচানো সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যানজট সমস্যার সমাধান করতে হলে সরকারি উদ্যোগ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জনসচেতনতা- এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে কার্যকর করতে হবে। সর্বশেষে, সড়কে যানজট নিরসনের জন্য এবং সময় অপচয় রোধ করার জন্য সকলকে সচেষ্ট হতে হবে, যা মূল্যবান সময় জীবন রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সড়কের যানজট নিরসনের মাধ্যমেই সমাজ তার প্রকৃত নিয়ম অনুসারে চলাচল করতে পারবে এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে।

 

শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ

 

×