ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

দোয়া মোনাজাত

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ১৯:৫৪, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

দোয়া মোনাজাত

দোয়া ও প্রার্থনা এক ধরনের ইবাদত এবং মহান আল্লাহতা’য়ালার নিকটবর্তী হওয়ার এক পূতঃ মাধ্যম। এ দোয়া ও প্রার্থনা করার কিছু আদব ও নিয়ম রয়েছে। আমরা সৃষ্টি, আল্লাহ আমাদের মহান স্রষ্টা। তিনি দয়াপরবশ হয়ে আমাদেরকে অপরূপভাবে সৃষ্টি করেছেন, দিয়েছেন আমাদের জীবন, চলার উপায়-উপকরণ। আমাদেরকে প্রতিনিয়ত এর জন্য শোকরিয়া জানাতে হয়, এর জন্য সিজদা ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করতে হয়। তদুপরি আমাদের চলার পথে নানা চাহিদা, অসুবিধার কথা জানিয়ে তার সাহায্য কামনা করতে হয়।
আল্লাহতা’য়ালা আমাদের কল্যাণ বিবেচনা করে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রয়োজনীয় মদদ দান করেছেন। তিনি তো আমাদের সকলের একমাত্র উত্তম অভিভাবক ও উত্তম সাহায্যকারী। কিন্তু চাইতে না জানলে কখনো কোনো কিছু আদায় করা যায় না, কারো করুণা পাওয়ার জন্য চাই প্রার্থীর বিনীত ভাষণ। মহান স্রষ্টা আল্লাহু সুবহানাহুতা’য়ালার কাছে দোয়া-মোনাজাতকে মকবুল করে তোলার জন্য এর আদবগুলো অনুসরণ করা অপরিহার্য।
করুণাময় আল্লাহপাক নিজেই তাঁর দরবারে আলীশানে দোয়া করার নিয়ম শিখিয়ে দিচ্ছেন এভাবে : উদয়ূ রাব্বাকুম তাদাররুয়ান ওয়া খুফইয়াতান. . .।’ অর্থাৎ তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাকো-কাকুতিমিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না। পৃথিবীকে কুসংস্কার মুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে (তোমরা) ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না। তাঁকে আহব্বান করো ভয় ও আশাসহকারে। নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী। (৭ ঃ ৫৫-৫৬)।
উপরোক্ত আয়াতের মর্মবাণী অনুসারে দোয়া করাই হলো উত্তম পন্থা। আরবি ভাষায় দোয়া শব্দটির অর্থ বিবিধ। (এক) বিপদাপদ দূরীকরণ ও অভাব পূরণের জন্য কাউকে ডাকা এবং (দুই) যে কোনো অবস্থায় কাউকে স্মরণ করা। এ আয়াতে উভয় অর্থই হতে পারে। বলা হয়েছে : উদয়ূ রাব্বাকুমÑ অর্থাৎ অভাব পূরণের জন্য স্বীয় পালনকর্তাকে ডাক অথবা স্মরণ কর এবং প্রভুর ইবাদত কর।
প্রথমবস্থায় অর্থ হবে, স্বীয় অভাব-অনটনের সমাধান একমাত্র আল্লাহরই কাছে প্রার্থনা করা। আর দ্বিতীয় অবস্থায় অর্থ হবে, স্মরণ ও ইবাদত একমাত্র তাঁরই করা। উভয় ব্যাখ্যায় পূর্ববর্তী মনীষী ও তাফসিরবিদগণের কাছ থেকে বর্ণিত হয়েছে। এর পর বলা হয়েছে : তাদররুয়ান ওয়া খুফইয়াতানÑশব্দ দু’টির অর্থ যথাক্রমে অক্ষমতা, বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করা এবং গোপন।
শব্দদ্বয়ে দোয়া ও স্মরণের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ আদব বর্ণিত হয়েছে। প্রথমত, অপারগতা ও অক্ষমতা এবং বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করে দোয়া করা, তা কবুল হওয়ার  জন্য জরুরি শর্ত। দোয়ার ভাষা অক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। বলার ভঙ্গি ও দোয়ার  আকার, আকৃতিও বিনয় এবং নম্রতাসূচক হওয়া চাই।
এতে  বোঝা যায় যে, আজকাল জনসাধারণ যে ভঙ্গিতে দোয়া প্রার্থনা করে একে দোয়া প্রার্থনা বলা যায় না বরং দোয়া পড়া বলা উচিৎ। কেননা, প্রায়ই জানা থাকে না যে, মুখে যেসব শব্দ উচ্চারণ করা হচ্ছে তার অর্থ কি? দোয়া প্রার্থনার যে স্বরূপ তা এক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। এটা ভিন্ন কথা যে, আল্লাহতা’য়ালা স্বীয় কৃপায় এসব নিষ্প্রাণ বাক্য কবুল করে নিতে পারেন কিংবা এগুলো কুরআনের আয়াত সম্বলিত হলে এর প্রতিটি হরফের বদলায় নেকী দিতে  পারেন। কিন্তু একথা  বোঝা দরকার যে, দোয়া প্রার্থনা পাঠ করার বিষয় নয়। কাজেই চাওয়ার যথার্থ রীতি অনুযায়ী চাইতে হবে। এছাড়া যদি কারো নিজ বাক্যাবলীর অর্থও জানা থাকে এবং তা বুঝেসুজে বলে, তবে বলার ভঙ্গি এবং বাহ্যিক আকার-আকৃতিতে বিনয় ও নম্রতা ফুটে না উঠলে এ দোয়াও দাবিতে পরিণত হয়, যা করার অধিকার কোনো বান্দারই নেই।
মোট কথা, প্রথম শব্দে দোয়ার প্রাণ ব্যক্ত করা হয়েছে যে, স্বীয় অক্ষমতা, দীনতা, হীনতা এবং বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করে আল্লাহর কাছে অভাব-অনটন ব্যক্ত করা। দ্বিতীয়ত, এখানে আরও একটি নির্দেশ রয়েছে যে, চুপিচুপি ও সংগোপনে দোয়া করা উত্তম এবং কবুলের নিকটবর্তী।  উচ্চৈস্বরে দোয়া চাওয়ার মধ্যে বিনয় ও নম্রতা বিদ্যমান থাকা কঠিন। এতে এটিও প্রকাশ পায় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি একথা জানেন না যে, আল্লাহতা’য়ালা শ্রোতা ও মহাজ্ঞানী, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবই তিনি জানেন এবং সরব-নীরব সব কথাই তিনি শোনেন।
এ কারণে খায়বার যুদ্ধের সময় দোয়া করতে গিয়ে সাহাবায়ে কেরামের আওয়াজ  উচ্চৈ হয়ে গেলে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা কোনো বধিরকে অথবা অনুপস্থিতকে ডাকাডাকি করছো না যে, এত জোরে বলতে হবে . . .।’ (মা’আরিফুল কুরআন)। স্বয়ং আল্লাহতা’য়ালা জনৈক সৎকর্মীর দোয়া উল্লেখ করে বলেন : ‘ইজ নাÑদা-রাব্বাহু নিদায়ান খফিয়্যাÑ যখন সে তার পালনকর্তাকে চুপিসারে ডাকল।’ এতে  বোঝা যায় যে, অনুচ্চস্বরে দোয়া করা আল্লাহর পছন্দনীয়। হযরত হাসান বসরী (রাহ.) বলেন, প্রকাশ্যে এবং সজোরে দোয়া করা এবং নীরবে অনুচ্চস্বরে দোয়া করা; এতদুভয়ের ফজীলত ৭০ ডিগ্রি তফাৎ রয়েছে।
পূর্ববর্তী মনীষীবৃন্দ অধিকাংশ সময় আল্লাহর স্মরণে ও দোয়ায় মশগুল থাকতেন। কিন্তু কেউ তাদের আওয়াজ শুনতে পেত না। তাদের দোয়া তাদের ও আল্লাহর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। তিনি বলেন, আমি এমন অনেককে দেখেছি যারা গোপনে সম্পাদন করার মতো কোনো ইবাদত কখনো প্রকাশ্যে করেননি। দোয়ায় তাদের আওয়াজ অত্যন্ত অনুচ্চ থাকত। (ইবনে কাসীর আহকাম, মাজহারী)। অভাব-অনটনের ব্যাপারে দোয়া করা সম্পর্কে এ পর্যন্ত বর্ণনা করা হলো।
উল্লেখ্য, কুরআনের আয়াত বর্ণিত দোয়ার অর্থ যদি যিকির ও ইবাদত নেওয়া হয়। তবে এ সম্পর্কেও পূর্ববর্তী মনীষীদের অভিমত এই যে, নীরবে জিকির সরব জিকির অপেক্ষা উত্তম। সূফীগণের মধ্যে চিশতিয়া তরীকার  বুজুর্গগণ মুরীদকে প্রথম পর্যায়ে সরব জিকির শিক্ষা দেন। তারা সংশ্লিষ্ট অবস্থার প্রতিকার হিসেবে এরূপ করেন, যাতে শব্দের মাধ্যমে অলসতা দূর করা যায়। এবং জিকিরের মাধ্যমে আত্মার সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে।
অবশ্য এ বৈধতাও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। যেমন এক জায়গায় আঁ-হযরত (সা.) এরশাদ করেছেন : ‘ছালাছু সাউতি ইউহিব্বুললাহু সাওতুদ দীক, সাওতাললাজি ইয়াকরাউল কুরআনÑ ওয়া সাউতুললাজি ইয়াদউ বিল আসহার’। অর্থাৎ তিন প্রকার আওয়াজ আল্লাহর পছন্দ ১. মোরগের ডাক ২. কুরআন তিলাওয়াতকারীর আওয়াজ এবং ৩. শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীর আওয়াজ। তবে এক্ষেত্রে আমাদের অনুসন্ধান হলো সর্বোত্তম ও সর্বোকৃষ্ট দোয়া চিহ্নিত করা।
হযরত সা’দ (রা.) হুজুর (সা.) এঁর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, নীরব জিকির উত্তম এবং ঐ জিকির উত্তম যা যথেষ্ট হয়ে যায় (আহমদ, বায়হাকী)। অবশ্য বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ও সময় সরব জিকিরই কাম্য এবং উত্তম ফলদায়ক। যেমন আজান ও ইকামত উচ্চৈস্বরে বলা, নামাজে কোনো কোনো কিরাত ও তাকবির উচ্চৈস্বরে বলা এবং হজে ‘লাব্বাইক’ ধ্বনি দেওয়া।
এ জন্য উপসংহারে ইসলামী আইনবিদগণের সিদ্ধান্ত এই যে, আঁ-হযরত (সা.) যেসব বিশেষ অবস্থা ও স্থানে কথা ও কর্মের মাধ্যমে সরব জিকির করার শিক্ষা দিয়েছেন সেখানে সজোরেই করা উচিৎ। আর অন্যান্য অবস্থা ও স্থানে নীরব জিকিরই উত্তম ও অধিক উপকারী। আমরা যেন জিকির-আযগার, তিলাওয়াত-তাসবিহ এবং ইবাদত বন্দেগীতে আল্লাহ সুবহানাহুতা’য়ালার রিজামন্দি হাসিলের সর্বোৎকৃষ্ট হিকমত ও পন্থা অবলম্বনের কোশেশ করি।

লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

×