ছবি - জনকণ্ঠ
সৌদি আরব বললেই আমাদের মাথায় প্রথম যে চিত্রটি আসে তা হচ্ছে মক্কা বা মদিনা। এর সাথে আরো যুক্ত হয় খুবই কনজারভেটিভ একটি সমাজ। কিন্তু না। বর্তমান সৌদি আরব আমাদের এই পুরোনো ধ্যান-ধারণাকে ভেঙ্গে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু তার কতটুকু আমরা জানি। আমাদের দেশ থেকে গড়ে ১০ থেকে ১২ লক্ষ লোক প্রতিবছর বিদেশে পাড়ি জমায় চাকরির খোঁজে। এর মাঝে প্রায় 40 ভাগই যায় এই একটি দেশে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল যুগের পর যুগ ধরে এই দেশটিতে আমাদের দেশের লোকজন যাচ্ছে তাদের সবচেয়ে নিম্ন বেতনের চাকরিগুলি করার জন্য।
৩.২ মিলিয়ন বাংলাদেশি বসবাস করে এই দেশটিতে যাদের মাঝে প্রফেশনাল উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। অথচ বিগত দশকে এই দেশে তৈরি হয়েছে আমাদের প্রফেশনাল দের বিপুল সম্ভাবনা। যা সঠিকভাবে আমাদের দেশে যেমন তুলে ধরা হয়নি ঠিক একইভাবে অদক্ষ শ্রমিকদের ভিড়ে আমাদের যে দক্ষ professionals আছে সেটিও সৌদি আরবের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে আমরা হয়েছি ব্যর্থ।
শুধু এই একটি দেশে যদি আমরা আমাদের ইয়ং প্রফেশনাল দের কে নিয়ে যথাযথভাবে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং করতে পারি তাহলে বছরে আমাদের রেমিটেন্স বাড়ানো সম্ভব ১৮%।
আজ বিস্তারিত আলোচনা করব শুধু আইডি প্রফেশনাল দের নিয়ে। এর বাইরেও পর্যটন ও স্বাস্থ্যখাতে দক্ষ প্রফেশনালদের জন্য বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে এদেশে।
সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ। এই উদ্যোগের অধীনে দেশটি আইটি অবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ক্লাউড কম্পিউটিং, ব্লকচেইন, এবং সাইবার সিকিউরিটি-তে বিপুল বিনিয়োগ করছে।
🔹 আইটি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ: International Data Corporation (IDC) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌদি আইটি বাজার ৭.৫% বার্ষিক বৃদ্ধির হার (CAGR) অনুসারে ২০২৭ সালের মধ্যে ১৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে।
🔹 ডিজিটাল রূপান্তরের উদ্যোগ:
✅ National Transformation Program (NTP)—সরকারি পরিষেবাগুলোকে ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে।
✅ Saudi Data and AI Authority (SDAIA)—২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি আরব এআই-ভিত্তিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে।
✅ NEOM, The Line, Red Sea Project—৫০০ বিলিয়ন ডলারের স্মার্ট সিটি প্রকল্প যা আইটি বিশেষজ্ঞদের জন্য বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
সৌদি আরবের আইটি খাতের মূল চালিকাশক্তি
🔹 ই-গভর্নমেন্ট: Yesser Program সৌদি সরকারি সেবাগুলো ৯০% ডিজিটালাইজড করেছে, যার ফলে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সাইবার সিকিউরিটি এবং ডাটা অ্যানালিটিক্স-এর বিশেষজ্ঞদের জন্য বিশাল চাহিদা তৈরি হয়েছে।
🔹 ফিনটেক:
✅ ২০১৮ সালের পর সৌদি আরবে ফিনটেক স্টার্ট-আপ সংখ্যা ৩০০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
✅ সৌদি সেন্ট্রাল ব্যাংক (SAMA) ব্লকচেইন ও ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করছে।
🔹 সাইবার সিকিউরিটি:
✅ ২০২৫ সালের মধ্যে সৌদি সাইবার সিকিউরিটি বাজার ৪.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
🔹 স্বাস্থ্যসেবা আইটি:
✅ ২০২৬ সালের মধ্যে সৌদি স্বাস্থ্যসেবা আইটি খাত ১.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশি আইটি পেশাজীবীদের জন্য সৌদি আরবে সম্ভাবনা:
উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন চাকরি
✅ সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট: Python, Java, C++ জানা প্রোগ্রামারদের চাহিদা ব্যাপক।
✅ সাইবার সিকিউরিটি: Ethical hacking, risk management-এর অভিজ্ঞদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
✅ এআই ও ডাটা সায়েন্স: মেশিন লার্নিং ও বিগ ডাটা বিশ্লেষকদের জন্য বিশাল সুযোগ রয়েছে।
✅ ক্লাউড কম্পিউটিং: AWS, Azure, Google Cloud সার্টিফাইড পেশাজীবীদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন: সৌদি আরবও হতে পারে আদর্শ গন্তব্য
বাংলাদেশি আইটি পেশাজীবীদের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা কানাডার চাকরিকে সেরা সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সৌদি আরব এখন একটি অন্যতম আইটি হাব হিসেবে গড়ে উঠছে এবং এখানে প্রতিযোগিতা তুলনামূলকভাবে কম।
আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রফেশনালরা (ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন) সৌদি আইটি বাজারে দ্রুত প্রবেশ করছে, এমনকি নিম্ন বেতনে শুরু করেও। কারণ তারা জানে, একবার সুযোগ পেলেই নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করে কয়েক মাসের মধ্যেই ভালো সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব।
কিন্তু বাংলাদেশি পেশাজীবীরা অনেক সময় শুধু তাৎক্ষণিক সুবিধা (বেতন, সুযোগ-সুবিধা) হিসাব করেই সিদ্ধান্ত নেন, বড় সুযোগটি মিস করেন। সৌদি আরবে একবার প্রবেশ করতে পারলে, এটি ইউরোপ বা আমেরিকার চাকরির সমান প্রতিযোগিতামূলক ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে।
অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের প্রতিযোগীদের মূল মন্ত্র হলো= অভিজ্ঞতা + দক্ষতা + বাজারে দ্রুত প্রবেশ = দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার গ্রোথ
আর ঠিক এখানটায় পিছিয়ে গেছে আমাদের পেশাজীবীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় গুলি যেমন বহির্বিশ্বের চাকরির বাজার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিচ্ছে না, আমার অন্যভাবে পড়াশোনা শেষ করে ক্যারিয়ার কোথায় হবে কোন দেশের কি কি সুযোগ-সুবিধা আছে সেসব নিয়ে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের বিস্তারিত জানার আগ্রহ তুলনামূলকভাবে অন্য দেশের ছেলে মেয়েদের চেয়ে কম। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের বিশ্ববিদ্যালয় পরা অবস্থাতেই ছেলেমেয়েরা যে দেশে ক্যারিয়ার তৈরি করতে চায় সেইসব দেশ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং সেই দেশে নিজ দেশের প্রবাসীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে প্রয়োজনীয় স্কিল ডেভেলপমেন্টের কাজটিও সম্পন্ন করে ফেলে। এতে পাস করার সাথে সাথে যেমন সেসব দেশে তাদের চাকরির ক্ষেত্রটি থাকে উন্মুক্ত তেমনি দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার পরিকল্পনাতেও তারা থাকে অনেক এগিয়ে।
সরকারকে যেমন আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে স্থানীয় বাজারে প্রচার করতে হবে,একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও সেইসব বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সম্পন্ন professionals তৈরি করতে হবে।
আগামী পাঁচ থেকে দশ বছর কোন কোন দেশে কোন কোন খাতে কি ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে তৈরি হবে এই বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা প্রদানের সাথে সাথে সেই সব চাকরিতে যোগ্য হিসেবে তৈরি করার জন্য কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে এই দুটি পদক্ষেপ এক সুতোয় গাঁথা। শুধু এই Combination না থাকার কারণে আমরা হারাচ্ছি বৈশ্বিক উন্মুক্ত শ্রমবাজার। অদক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পাঠাতে বাংলাদেশের কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে অদক্ষ শ্রমিকের দেশ। বাধ্য হয়ে সেখান থেকে সবেমাত্র দক্ষ শ্রমিকের দিকে আমাদের নজর পড়ছে। অথচ আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েরা গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে এই বৈশ্বিক বাজারে নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে পারে। 80 দশকের শুরু হওয়া ম্যানপাওয়ার বা আদম ব্যবসার কনসেপ্ট এর ভেতরেই আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা ও পলিসি আটকে আছে। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা যদি হিউম্যান রিসোর্স নিয়ে পদক্ষেপ না নেই তাহলে দিনশেষে আমরাই হারাবো এই উন্মুক্ত বৈশ্বিক চাকরির বাজারে নিজেদের তুলে ধরার এই সুযোগ। এবং তা করতে হবে এখনই। আগামী ১০ বছর পরে আমাদের জনগোষ্ঠীর যে বয়স হবে তাতে তখন চাইলেও আমরা আর এই সুযোগ নিতে পারব না। শুধু দরকার একটি বাস্তবসম্পন্ন পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন।
কেন বাংলাদেশি আইটি পেশাজীবীদের সৌদি আরব বেছে নেওয়া উচিত?
✔ উচ্চ বেতন ও করমুক্ত আয়
✔ প্রতিযোগিতামূলক চাকরি, যেখানে দক্ষতা থাকলে দ্রুত উন্নতি সম্ভব
✔ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজের সুযোগ (Google, Microsoft, Amazon-এর মতো প্রতিষ্ঠান সৌদিতে শাখা খুলছে)
✔ সৌদি-বাংলাদেশ সংস্কৃতির মিল থাকায় সহজে মানিয়ে নেওয়া যায়
বাংলাদেশি আইটি পেশাজীবীদের জন্য প্রস্তুতি ও কৌশল
🔹 সার্টিফিকেশন ও দক্ষতা বৃদ্ধি করুন: AWS, Microsoft, Google Cloud, Cisco সার্টিফিকেট অর্জন করুন।
🔹 প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিং করুন: LinkedIn, GitHub, Upwork-এর মাধ্যমে সৌদি কোম্পানির সাথে সংযোগ তৈরি করুন।
🔹 ভিসা ও চাকরির নিয়ম সম্পর্কে জানুন: সরকারি অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে চাকরি খুঁজুন।
🔹 সংস্কৃতি ও ভাষা শিখুন: আরবি ভাষার মৌলিক ধারণা থাকলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে।
সৌদি আরব: বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার
সৌদি আরবের ডিজিটাল রূপান্তর বাংলাদেশি আইটি পেশাজীবীদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করছে। বর্তমানে ইউরোপ বা আমেরিকায় চাকরির প্রতিযোগিতা অনেক বেশি, কিন্তু সৌদি আরব এখনো তরুণ ও দক্ষ জনশক্তির সন্ধান করছে।
বাংলাদেশি আইটি কর্মীরা যদি দক্ষতা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং বাজারের বাস্তবতা বোঝে, তবে সৌদি আরবে উন্নত ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সম্ভব।
জাফরান