মুক্তিযুদ্ধ
হাঁড়িতে যখন ভাত রান্না শুরু হয়, তখন ঢাকনা উপরে থাকলেও, পানি গরম হতে হতে একসময় তা উথলে ওঠে। ঢাকনা দিয়ে উত্তপ্ত পানিকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না, যেমন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। তেমনি ২৪-এর ঘটনাপ্রবাহ দিয়ে ৭১-এর চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করাও অসম্ভব।
একটু পেছনে তাকানো যাক। মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮৩) ছিল গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আমেরিকার তেরো উপনিবেশের বিদ্রোহ, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়। শুরুতে এটি উপনিবেশে সীমাবদ্ধ থাকলেও ফ্রান্স ও স্পেনের সম্পৃক্ততায় যুদ্ধ ইউরোপ, ক্যারিবীয় এবং ইস্ট ইন্ডিজে ছড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে প্রায় ২৫ হাজার মার্কিনি নিহত হন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫) দেশটির ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এটি মূলত ফেডারেল সরকার ও দাস-নির্ভর ১১টি বিদ্রোহী প্রদেশের মধ্যে সংঘটিত হয়। বিদ্রোহী প্রদেশগুলো রাষ্ট্রপতি জেফারসন ডেভিসের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে "কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকা" গঠন করে। রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে ইউনিয়ন সরকার ও রিপাবলিকান দল তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যারা দাসপ্রথার বিস্তারের কঠোর বিরোধী ছিল। চার বছর ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধে প্রায় ৬ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, যা আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এত বড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরও কি তারা তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করেছে? কখনোই না, করবেও না। স্বাধীনতা তার মহিমায় বিদ্যমান ছিল, আছে, এবং থাকবে।
২০২৪ সালে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু একটি সত্য দিনের আলোর মতো স্পষ্ট—এই বাংলাদেশ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ফসল। যারা এই সত্যকে অস্বীকার করতে চায়, তারা দেশের শত্রু।
২৪ আমাদের নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, নতুন আশার আলো দেখিয়েছে, কিন্তু ৭১-কে ভুলে নয়। কেন এই আলোচনা? কারণ একটি পক্ষ ২৪-কে বিশেষ গুরুত্ব দিতে গিয়ে ৭১-কে অবজ্ঞা করার সুযোগ নিচ্ছে। ২৪ অবশ্যই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গর্বের অধ্যায়, কিন্তু তা ৭১-এর গুরুত্বকে খাটো করে নয়। যারা ৭১ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তারাই আসলে ৭১-কে ঢাকতে চায়।
সম্প্রতি ছাত্রশিবির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম সম্পাদিত "ছাত্র সংবাদ" পত্রিকায় আহমেদ আফগানীর লেখা "যুগে যুগে স্বৈরাচার ও তাদের করুণ পরিণতি" শীর্ষক প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য এসেছে। তিনি লিখেছেন, ‘সে সময়ের অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।’
এটি নিঃসন্দেহে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য। কিছু গোষ্ঠী ১৯৭১-এর রক্তার্জিত বিজয়কে অবজ্ঞা করতে চায়, সংবিধানকে বাতিল করার অপচেষ্টা চালায়। সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যেতে পারে, তবে একে পুরোপুরি বাতিল করার চিন্তাভাবনাই সন্দেহজনক।
কেউ কেউ সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের কাতারে ২৪-এর অভ্যুত্থানকে স্থান দিতে চাচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ৭১ নিয়ে প্রশ্ন তুললেই অনেকে একে আওয়ামী লীগের ‘ক্যাসেট’ বলে চালিয়ে দেয়। সত্য হলো, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, তবে এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার করা যায় না। জাতিকে বিভক্ত করে এমন যেকোনো বিতর্ক আমাদের ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি ঘটনা নয়, এটি ছিল এক মহাকাব্যিক সংগ্রাম। লক্ষ প্রাণের বিসর্জনে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। গণহত্যা, পূর্বপুরুষদের ওপর অমানবিক নির্যাতন এবং মা-বোনের সম্ভ্রমহানির ইতিহাস কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। অথচ কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকৃত করেছে, এটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ কোনো একক দলের সম্পত্তি নয়; এটি ছিল সমগ্র জাতির সংগ্রাম। আওয়ামী লীগ একে পুঁজি করে রাজনীতি করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন করেনি, কিছু মুক্তিযোদ্ধা বিপথগামীও হয়েছে। তবে এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দোষী নয়।
একইভাবে, ২৪-এর অভ্যুত্থানকেও কিছু গোষ্ঠী নিজেদের সম্পত্তি বানানোর চেষ্টা করছে। জাতীয় অর্জনকে ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে ব্যবহার করা হলে, তার পরিণতি হাসিনার একদলীয় শাসনের মতোই হবে।
স্বাধীনতার সত্য কখনো বদলায় না—মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা একাত্তরকে অস্বীকার করে, তারা আসলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। আওয়ামী লীগ ‘একাত্তর’ ও ‘চেতনা’ শব্দগুলোকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, কিন্তু একাত্তর অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশের জন্মকে অস্বীকার করা।
বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বই এবং চব্বিশ—এই ইতিহাস শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং আমাদের জাতীয় সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও বিজয়ের প্রতীক। কেউ একে নিজেদের সম্পদ হিসেবে দাবি করতে পারে না, আর কাউকে তা করতে দেওয়া যাবে না।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়, আর এটিকে যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করাই আমাদের দায়িত্ব। আমাদের যা কিছু হয়েছে, যা কিছুই হবে—তা ৪৭-এর হাত ধরে, ৫২-এর পথ ধরে, সর্বোপরি ৭১-এ পাওয়া চূড়ান্ত বিজয়ের হাত ধরেই। ৯০, ২৪—এসব আমাদের বিজয়ের ইতিহাসের নতুন পালক।
২৪ আমাদের হৃদয়ে গভীর দাগ কেটেছে, নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে, নতুন সুরে গান গাইতে শিখিয়েছে। এটি মনে থাকবে, মনে রাখব, তবে ৭১-কে ভুলে নয়।
লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
শহীদ