ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ভালোবাসতে হবে দেশকে

মো. মাসুদ চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:০৯, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ভালোবাসতে হবে দেশকে

একটি জাতির উন্নতি নির্ভর করে তার নাগরিকদের দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের ওপর। দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতা যদি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে না ওঠে, তবে সেই জাতি কখনোই উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাতে পারে না। যেসব দেশ ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশপ্রেম ও জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তারা উন্নতি লাভ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের উদাহরণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, ফিনল্যান্ড, চীন ও নরওয়ে তাদের মধ্যে অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত জার্মানিকে পুনর্গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐক্য ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে। দেশটি পুনর্গঠনে ভক্সওয়াগেন, বিএমডব্লিউর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিগত মুনাফার চেয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আবার, ১৯৫০-এর কোরীয় যুদ্ধের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত দক্ষিণ কোরিয়ার পুনর্গঠনে জনগণ ও কোম্পানিগুলো (স্যামসাং, এলজি ও হুন্দাই) জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থনীতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে নজিরবিহীন অগ্রগতি অর্জন করেছে। এছাড়াও সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ-এর নেতৃত্বে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানের পুনর্গঠন, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা খাতের উন্নয়ন, রুয়ান্ডার গণহত্যা পরবর্তী উন্নয়ন, চীনের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক সংস্কার এবং নরওয়ের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয়েছে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশপ্রেম ও জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে।
কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ প্রায় সময়ই একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ করে থাকে। মানুষ জন্মগত ও সংস্কৃতির প্রভাবে নিজের ও পরিবারের যত্ন ও সুরক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে, যা প্রশংসনীয় একটি কাজ। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের কাজটি যখন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে যায়, তখন তা ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করে। যেসব দেশ জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে, তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সিরিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ সুদান, ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন, হাইতি ও সোমালিয়ার কথা বলা যেতে পারে। বাশার আল-আসাদের শাসন ও বিরোধী দলগুলোর ব্যক্তিগত ক্ষমতার লড়াই সিরিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে। লিবিয়ায় ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার লোভের কারণে তেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও জনকল্যাণ উপেক্ষিত হয়েছে। এছাড়া, হাইতি ও দক্ষিণ সুদানের দুর্নীতি, ভেনিজুয়েলার জনসাধারণের দারিদ্র্য, ইয়েমেনে ক্ষমতার লড়াই, সোমালিয়ার সংঘাত ও জিম্বাবুইয়ের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার মূল কারণ হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের কল্যাণকে স্থান না দিলে কোনো দেশ স্থায়ী উন্নয়ন করতে পারে না।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ। দেশটিতে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে কাজ করার মানুষ যেমন আছে, তেমনি জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মানুষও আছে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদরা তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও স্বার্থ ত্যাগ করে স্বাধীনতার (জাতীয় স্বার্থ) জন্য লড়াই করেছেন এবং দেশকে স্বাধীন করেছেন, যা দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশপ্রেমিকদের ত্যাগ ও অবদান আজও আমাদের জাতিকে অনুপ্রাণিত করে। স্বাধীনতা পরবর্তী, দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতা প্রকাশ পেয়েছে জাতীয় সংকট মোকাবিলা, পরিবেশ রক্ষা, কর প্রদান, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সামাজিক ও অন্যান্য জনহিতকর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। এই ধরনের দেশপ্রেমিক মানুষের অবদান বাংলাদেশের উন্নয়নে অমূল্য ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে জাতীয় স্বার্থ থেকে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যাদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই জাতির কল্যাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও অন্যান্য পেশাজীবী নিজেদের স্বার্থকে দেশের সুশাসন ও জনগণের কল্যাণের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং বিভিন্ন অপকর্ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের ক্ষতিসাধন করেছে। অর্থ পাচার, কমিশন ব্যবসা, সিন্ডিকেট বাণিজ্য, সোনা চোরাচালান, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পক্ষপাত এবং ব্যাংকিং, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি এরই প্রমাণ বহন করে। এসব কাজ করার জন্য তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেই এই ধরনের ব্যক্তি বিদ্যমান। সংখ্যাটি কম হলেও এদের কারণে দলের সত্যিকারের নেতারা, যারা দেশ ও দলের মঙ্গলের জন্য চিন্তা ও কাজ করেন, সর্বদা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। ব্যক্তিস্বার্থের ব্যক্তিদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড দলকেও দেশকে উন্নয়ন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অধঃপতন নেমে আসে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অধঃপতন এরই প্রমাণ বহন করে। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। তাই, বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলেও ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ চাঁদাবাজি ও দখলের হাতবদল, বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ, মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধের কথা বলা যেতে পারে।
কিন্তু দেশের কল্যাণের কথা বিবেচনায় আনলে, সবার ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করা উচিৎ। কেননা, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করলেই জাতীয় উন্নয়ন, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়। সবাই যখন দেশের জন্য কাজ করবে তখন বিভাজনের বদলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বাড়বে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে দুর্নীতি কমে যাবে এবং সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। জনগণের মধ্যে কর পরিশোধ এবং আইন মেনে চলার প্রবণতা বাড়বে, যার ফলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে সহায়তা করবে। এছাড়া, জনসাধারণ নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করলে সমাজের অধিকাংশ মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে, যা বৈষম্য দূর করবে এবং নৈতিক ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
তাই, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে জাতীয় স্বার্থে কাজ করার সংস্কৃতি আমাদের সকলের সমন্বিত চেষ্টায় দীর্ঘমেয়াদে হলেও তৈরি করতে হবে। এর জন্য সকল পর্যায়ে সবাইকে, বিশেষ করে নির্বাচিত সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বজনপ্রীতি ও তোষামোদের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যোগ্য, ত্যাগী ও জাতীয় স্বার্থে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে দল ও প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের ভার প্রদান করতে হবে। নিজের, প্রতিষ্ঠানের ও দলের সমালোচনাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। কেননা, অনেক ক্ষেত্রে দলের বা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দল বা প্রতিষ্ঠান থেকে ছিটকে পড়া বা পদাবনিতর ভয়ে সঠিক তথ্যটি দলের নেতা বা প্রধানদের দিতে চান না বা চাইলেও তাদের কাছে সরাসরি দিতে পারেন না। আর এই সুযোগেই ব্যক্তিস্বার্থের নেতা বা কর্তারা দুর্নীতিতে ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এছাড়া, সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও বিচারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারলে, সকল পর্যায়ে ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি বা অপরাধ করার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যাবে। পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দেশপ্রেম তৈরি করতে দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কেননা, পরিবার একজন শিশুর প্রথম শিক্ষাঙ্গন যেখানে শিশুর মধ্যে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও আচরণের বীজ বপন করা হয়। পরিবারে দেশপ্রেমের চর্চা হলে শিশুর মধ্যে ছোটবেলা থেকেই দেশের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ এবং সম্মান গড়ে ওঠে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধ, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নেতৃত্বের দক্ষতা তৈরি, পরিচর্যা ও পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করে।
আমরা যদি নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের দেশ একদিন উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে। দেশপ্রেম এবং দায়িত্ববোধের মাধ্যমে আমরা একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবীর নিশ্চয়তা দেবে।  

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

×