ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্র

মিনহাজুর রহমান শিহাব

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫

পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্র

নদী বেষ্টিত আর অন্যপাশে সারি সারি পাহাড়

একপাশে সমুদ্র, নদী বেষ্টিত আর অন্যপাশে সারি সারি পাহাড়ের অপূর্ব নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে গড়া টেকনাফ উপজেলা। বিভিন্ন প্রজাতির বিচিত্র গাছপালাতে স্থানীয় জনপদ সমৃদ্ধ হলেও এখানকার পান সুপারির বেশ নাম-ডাক রয়েছে দেশজুড়ে। ফলে স্থানীয়ভাবে সুপারি বাগানের আবাদ করার প্রবণতা বেশ চোখে পড়ে।

সারি সারি সজ্জিত সুপারি গাছের বাগানে একসময় সুপারি গাছের খোল বা পাতা পড়ে থাকতে দেখা গেলেও সময়ের ব্যবধানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সে দৃশ্য আর দেখা যায় না। সুপারি গাছের শুকনো খোল বা পাতা বাই প্রোডাক্ট বা উপজাত পণ্য যেন এখন আর্থিক সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে। টেকনাফ উপজেলার অন্তর্গত শ্যামলাপুর ইউনিয়নের এক স্বপ্নবাজ যুব উদ্যেক্তা মনির আহমদ সুপারি গাছের শুকনো খোল থেকে মেশিনের সাহায্যে তৈরি করছেন থালা, বাটি, নাশতার প্লেট, ট্রেসহ বিভিন্ন রকমের তৈজসপত্র।

এনজিও সেক্টরে কর্মজীবন শুরু হলেও সুদৃঢ় মনোবল ও একাগ্র প্রচেষ্টায় তিনি অল্প সময়ে গড়ে তুলেছেন ‘মনির এন্টারপ্রাইজ’ নামক প্রতিষ্ঠান, যেখানে দিনে ২৫০-৩০০ পিস পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্র তৈরি হচ্ছে। টেকনাফে পরিবেশ ও বনভূমি সংরক্ষণে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোডেকের ‘ন্যাচার এন্ড লাইফ’ প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালে মনির আহমেদ নিজ পুঁজির সঙ্গে কিছু আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং দ্রুতই সফলতার মুখ দেখে।

অল্প দিনেই তার তৈরি পরিবেশবান্ধব এসব সামগ্রী বেশ সাড়া ফেলে এবং উপজেলার চাহিদার পাশাপাশি কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকায়ও প্রশংসা কুড়ায়। বাজারে ব্যবহৃত সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বা একবার ব্যবহার উপযোগী প্লেটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব এসব সামগ্রীর ব্যবহারে উৎসাহ ও সচেতনতা বাড়ছে দিন দিন। শুরু থেকে এতদিন একটি মেশিন দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চললেও বর্ধিত চাহিদার আলোকে বর্তমানে আরও দুটি মেশিন মনিরের কারখানায় যুক্ত হয়েছে।

ফলে দৈনিক গড়ে ৯০০-১০০০ পিস তৈজসপত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে তার প্রতিষ্ঠান। সুপারির জন্য বিখ্যাত টেকনাফ উপজেলা ও এর আশপাশের এলাকায় সারি সারি সুপারি গাছের বাগান রয়েছে। এসব বাগানে ঝরে পড়ে থাকা গাছের খোল বা বাইল আগে মাটিতে পড়ে থাকত বা  মাঝে মধ্যে বসতবাড়ির আঙিনায় বেড়া হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কেউ বা আবার জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করত।

মনিরের ওই উদ্যোগের পর এসব খোল বা বাইল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের আগে গোড়ার অংশ কেটে তা বিক্রির (প্রতি খোল ১-১.৫০ টাকায়) সুযোগ পেয়েছে বাগান মালিকরা। এতে একদিকে যেমন- সুপারি বিক্রির ফলে আয় হচ্ছে, অন্যদিকে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে সুপারি গাছের খোল বিক্রি করে বাড়তি আয় এবং খোল থেকে পরবর্তীতে তৈরি নান্দনিক সব তৈজসপত্র বাজারজাতকরণ আরও পরিচিত করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির পাশাপাশি অনেক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। মনিরের এই কার্যক্রমে খোল সংগ্রহ, বাছাইকরণ, প্রস্তুতকরণ প্রভৃতি কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় ৬-১০ জন নারী ও পুরুষের।

সুপারি গাছের পাতা পুনঃব্যবহার করে তৈরি এসব বাসনপত্র, বাড়ির কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন হোটেলে, রেস্তোরাঁয় ওয়ান টাইম ব্যবহারে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে। বিশেষত কোনো অনুষ্ঠান, পিকনিক, সেমিনারে খাবার পরিবেশনকালে এর ব্যবহার কার্যকরী। স্বাস্থ্যকর ও রাসায়নিকমুক্ত এসব সামগ্রী দামে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য। আকারভেদে প্রতিটি বড় লাভ প্লেট (৯”)  ৮-১০ টাকা, রাউন্ড প্লেট (১০”) ১০ টাকা এবং ছোট বাটি (৫”) ৪-৫ টাকার মধ্যে বিক্রয় করা যায়।
পরিপূর্ণ পচনশীল হওয়ায় ব্যবহারের পর ফেলে দিলেও পরিবেশের কোনো প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। ইতোমধ্যে মনিরের তৈরি পরিবেশবান্ধব সামগ্রী স্থানীয় সৌখিন ও সচেতন মানুষের নজর কেড়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও গবেষক, পরিবেশবিদ ড. সোহাগ মিয়া বলেন, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে প্রত্যাহিক আচরণ সংশোধন যেমন- জরুরি, তেমনি এর বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পণ্য সামগ্রীর প্রচারও প্রয়োজন।

আমাদের আশপাশের পরিবেশ লব্ধ উপাদান প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দৈনন্দিন ব্যবহার উপযোগী পণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে প্লাস্টিক পলিথিন দূষণের কিছু সমাধান বের করা সম্ভব এবং পরিবেশ উপযোগী পণ্য ব্যবহারে উৎসাহ যোগাবে। এজন্য স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী সক্ষমতা কাজে লাগানো, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান এবং তৈরি পণ্য পরিচিতকরণ ও বিপণনে সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।  
এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনও। এছাড়া সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশবান্ধব এসব সামগ্রীর ব্যবহার প্রসারে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। উদ্যোক্তা বলেন, প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে সুপারি খোলের তৈরি তৈজসপত্র ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা গেলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও সেন্টমার্টিনকে রক্ষা করা সম্ভব। তিনি আরও জানান, পর্যটন মৌসুমে সুপারি খোলের তৈজসপত্রের চাহিদা থাকে বেশি।

কিন্তু বিগত বছরের তুলনায় এবার টেকনাফের পর্যটক কমে যাওয়ায় অর্ডারের পরিমাণও কমেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি তৈজসপত্র পরিচিতকরণ ও ব্যবহারে স্থানীয় রেস্তোরাঁ, হোটেল ও দোকানগুলোকে উৎসাহিত করলে সমুদ্রের দূষণ প্রতিরোধ দ্রুত সফলতা পাবে বলে মনে করেন তিনি।

লেখক : সমাজকর্মী

×