ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

সেলুলার জেলের আন্দামান

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫

সেলুলার জেলের আন্দামান

আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন

পাসপোর্টের পাতা ওল্টাচ্ছেন ইমিগ্রেশনের বাঙালি ভদ্রলোক। পোর্ট ব্লেয়ারের বীর সাভারকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন এলাকায় তখন বাইরের কড়া রোদের তাপ। কলকাতার মৃদু শীত তাড়াতে গায়ে চাপানো হাল্কা শীত পোশাকের হুল ফোটানো সামলে তখন অপেক্ষা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশে সরকারি ছাড়পত্রের জন্য। ছাড়পত্র ছাড়া প্রবেশ পুরো নিষেধ। 
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বীর সাভারকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আড়াই ঘণ্টার পথ। মাত্র আড়াই ঘণ্টায় ‘কালাপানি’র রহস্যময় আন্দামান! মনে গাঁথা গল্প-উপন্যাসের ভয়ংকর কালাপানি, দীপান্তরের চিত্রকল্প। বাস্তবের সঙ্গে কিছুতেই মেলে না। তা-ই স্বাভাবিক। সতেরোশ’ ঊননব্বইয়ে ইংরেজ নৌসেনা ক্যাপ্টেন কোলব্রুক ব্লেয়ারের দখল করা আন্দামানের সঙ্গে আজকের আন্দামানের আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
এয়ারপোর্টের বাইরে পা বাড়াতেই ঝকঝকে শহর। সহসা বোঝা যায় না যে শহরের রাস্তায় চলছি তা আসলে চৌদ্দশ’ ফুট উঁচু ছোট পাহাড়। দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ‘মাউন্ট হ্যারিয়েট’ এর আসল নাম। বোঝাই যায় ক্যাপ্টেন ব্লেয়ারের দখলের পর এর নাম বদলে গেছে। অনেক পর সুভাষ চন্দ্র বসু এর নাম দিয়েছিলেন ‘শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপ’।

ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এখানে দ্বীপান্তরে পাঠানো হতো বলেই হয়তো এ নাম তিনি দিয়েছিলেন। পোর্ট ব্লেয়ারে তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের পতাকা উড়েছিল উনিশশ’ তেতাল্লিশের ত্রিশ ডিসেম্বর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সে সময় ব্রিটিশ হটিয়ে আন্দামানের দখল নিয়েছিল জাপানিরা। কিন্তু স্থানীয়দের অসহযোগিতায় আজাদ হিন্দ ফৌজের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বছর দুয়েকের মধ্যে ফিরতে হয় তাদের।
রাজনৈতিক ইতিহাসের বাইরে আন্দামানের অসাধারণ নৃ ও ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের সূত্র সন্ধানের জন্য পোর্ট ব্লেয়ারের কেন্দ্রে রয়েছে এ্যান্থ্রোপোলজিক্যাল মিউজিয়াম। তিনতলা এ মিউজিয়ামের পুরোটা ঘুরলে উন্মোচিত হয় সে সবের অনেকটাই। আধুনিক মানব প্রজাতি (হোমোসেপিয়েন্স) উৎপত্তির পর আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে।

এশীয় উপকূল দিয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছানো ধারার একটি অংশ ভারতবর্ষের এসব দ্বীপমালায় আশ্রয় নেয়। সভ্যজগতের বাইরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দুর্গম গভীর অরণ্যে তাদের বহু শতাব্দীর বসবাস। এদের মধ্যে অনেকেই সভ্য জগতের সংস্পর্শে আসার বিষয়ে নমনীয় হলেও একটি অংশ এখনো হিংস্র ও দুর্ধর্ষ। সভ্য মানুষদের শত্রু মনে করে।

কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলে বিষাক্ত তীর ছুড়ে হত্যা করে। এরা ‘জারোয়া’ নামে পরিচিত। দেখতে কালো। শরীর পেশিবহুল এবং খাটো। ইংরেজিতে এদেরই ‘পিগমি’ বলে। ‘ওঙ্গি’, ‘সেন্টিনেলিস’ এবং ‘আন্দামানি’ নামে আরও তিনটি প্রজাতি রয়েছে এখানে।
ভূবিজ্ঞান অনুযায়ী আদিতে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জসহ মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি অঞ্চল এক বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগে একত্রিত ছিল। সমুদ্র তখন আরও দক্ষিণে। পরে বড় বড় ভূমিকম্প এবং    সুনামিতে সে বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ ডুবে যায়। সেখানে যেসব বড় পাহাড় ছিল, সেগুলোর চূড়াই নাকি এ দ্বীপপুঞ্জে পরিণত হয়েছে। ব্যারন আইল্যান্ড নামে পোর্ট ব্লেয়ারের একশ’ বিশ কিলোমিটার দূরে ছোট এক দ্বীপে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে।

সতেরোশ’ পঁচানব্বই সালে সেখানে প্রথম বিস্ফোরণ চোখে পড়ে এক ব্রিটিশ নাবিকের। আঠারোশ’ তিন এবং সাতান্ন সালে আবার জেগে ওঠে ব্যারন দ্বীপের আগ্নেয় পাহাড়। সর্বশেষ উনিশশ’ একানব্বই সালে জেগে উঠেছিল এটি। নরকোন্ডম নামে আরও একটি আগ্নেয় দ্বীপ রয়েছে এখানে। যদিও সেখানে কোনো বিস্ফোরণের খবর ইতিহাসে নেই। ছোট-বড় দু’শ’ চারটি দ্বীপ রয়েছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে। স্থলভাগের আয়তন ছয় হাজার তিন শ’ চল্লিশ বর্গকিলোমিটার। আন্দামান নিকোবরের একসঙ্গে মোট আয়তন আট হাজার দু’শ’ তিরানব্বই বর্গকিলোমিটার।
এ দ্বীপপুঞ্জের প্রতি ব্রিটিশরা মনোযোগী হয়েছিল মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আঠারো শতকের শেষদিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য জাহাজ ভারত মহাসাগরের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পূর্বের এ অঞ্চলেও ঘোরাফেরা করত। পূর্বদিক থেকে ভারতে প্রবেশের পথে আন্দামানই ছিল মূল দরজা।

সুতরাং সঙ্গত কারণেই তাদের এ মনোযোগ। আরও একটি পরিকল্পনাও হয়তো তাদের ছিল। যার সুসমন্বিত বহির্প্রকাশ পরবর্তীকালের বিখ্যাত ‘সেলুলার জেল’। কেননা, ক্যাপ্টেন ব্লেয়ারের দখল করা আন্দামান তখন বিপদসঙ্কুল দুর্গম জঙ্গলের আরেক নাম। জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য ব্লেয়ার সতেরোশ’ ঊননব্বই সালেই ভারত থেকে প্রায় তিনশ’ কয়েদি নিয়ে যান। তাদের দিয়ে দ্বীপের একটি অংশের জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে ছোট বসতি স্থাপন করেন।

কিন্তু জায়গাটি খুবই অস্বাস্থ্যকর, বিশেষ করে আশঙ্কাজনক ম্যালেরিয়া আক্রান্তপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ওখানে টেকা সম্ভব হয়নি ব্লেয়ার আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের। বছর তিনেক পর পোর্ট কর্নওয়ালিশ নাম দিয়ে অন্য একটি দ্বীপে বসতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু এখানেও একই অবস্থা। এত অস্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকতে কর্মচারীদের কোনোভাবেই আর রাজি করাতে না পেরে ব্লেয়ার সাহেবকে সে যাত্রা আন্দামানের পাট চুকাতে হয়।
ব্রিটিশ সরকার আন্দামানের প্রতি এরপর মনোযোগী হয় আঠারোশ’ সাতান্ন সালের সিপাহী বিপ্লবের পর। ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের প্রথম এই সংগঠিত প্রতিরোধ প্রচেষ্টা দমন করতে ব্রিটিশ সেনারা বিশাল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। অসংখ্য সাধারণ মানুষ এবং সিপাহীদের নির্বাসন দ- দিয়ে ভারতীয় জনগণের চোখের আড়ালে তিলে তিলে পিষে মারার জন্য দুর্গম আন্দামানকে বেছে নেয় তারা।

আঠারোশ’ আটান্ন সালে সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়- ‘যে সকল সিপাহী বিদ্রোহ করার অভিযোগে এবং যে সকল মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করার অভিযোগে নির্বাসন দ- পেয়েছে, প্রধানত তাদের জন্য এবং পরবর্তীকালের অন্যান্য দ-িত কয়েদি যাদের মালয় অথবা তেনাসেমীর প্রদেশে (মিায়ানমার) পাঠানো যুক্তিসঙ্গত মনে হবে না, তাদের (আটক) রাখার জন্য আন্দামানে একটি কয়েদি উপনিবেশ (Penal settlement) স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ (মুক্তিতীর্থ আন্দামান : গনেশ ঘোষ)। 

সিদ্ধান্তের প্রায় পরপরই বিদ্রোহী বন্দিদের আন্দামানে পাঠানো শুরু হয়। ষাট বছর আগে ইংরেজ কর্মচারীরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য যে জায়গা ছেড়ে এসেছিল, সেখানেই পাঠানো হয় ভারতীয় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রথম বীরদের। তখনো তা একই রকম অস্বাস্থ্যকর ও জনবসতির অনুপযোগী। বন্দিদের মধ্যে যারা কিছুদিন বেঁচে থাকত, তাদের নিজেদের মতো করে জঙ্গলেই আচ্ছাদন করে নিতে হতো।

সরকার থেকে তাদের জন্য থাকার কোনো ব্যবস্থা তখনো করা হয়নি। সে চেষ্টার শুরু আঠারোশ’ ছিয়ানব্বই সালে ‘সেলুলার জেল’-এর মাধ্যমে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে পোর্ট ব্লেয়ার শহরের প্রান্তে। এখন এটি মিউজিয়াম। সেলুলার জেলকে অনেকে বলেন বিশ শতকের ‘বাস্তিল’।

ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের প্যারি শহরে ফরাসী রাজাদের দুর্গ বাস্তিলে রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবীদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। সতেরোশ’ ঊননব্বইয়ের চৌদ্দ জুলাই এ দুর্গ ধ্বংস করার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ফরাসি বিপ্লব।
সাধারণত সব জেলে বিপজ্জনক বন্দিদের আলাদা রাখার জন্য বিশেষ কিছু সেল থাকে। তেমনি অন্য বন্দিদের একসঙ্গে থাকার জন্য হলঘরের মতো বড় ঘরও থাকে। কিন্তু সেলুলার জেলে শুধু সেল ছাড়া বন্দিদের থাকার আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কুঠরিগুলো এত ছোট যে, একসঙ্গে দুজনও থাকা সম্ভব নয়। সেজন্যই এর নাম ‘সেলুলার জেল’। অর্থাৎ কুঠরি কারাগার।

ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামীদের এখানে বন্দি করে নির্যাতন করা হতো। এ জেল তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক। টানা তিনতলা দুটো ভবনে একই মাপের সব কুঠরি। এর ওপর কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়া যায় ওয়াচ টাওয়ারের মতো আরও দুটো তলায়। এগুলো সম্ভবত পরে করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য। শেষ তলার ছাদ থেকে দেখা যায় তিন দিকের সমুদ্রের অপূর্ব দৃশ্য। মনে হয় পুরো পোর্ট ব্লেয়ার ঘিরে রেখেছে সমুদ্রের কালচে পানি।

পাহাড় চূড়ার সেলুলার জেল থেকে ঢালে নেমে একটু এগোলেই রাজীব গান্ধী ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স। এও এক অপূর্ব জায়গা। সমুদ্রের সান্নিধ্য উপভোগ করার জন্য অসাধারণ। একদিকে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ, অন্যদিকে লেগুনার শান্ত পানি। তিন দিকে টানা ব্রিজ। সমুদ্রের দিকের ব্রিজে একটু পরপর লোহার বেঞ্চ পাতা। মূলত এ্যাবারডিন সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যুক্ত করে বানানো হয়েছে এ কমপ্লেক্স। লোকজনের ভিড় নেই। হৈচৈ নেই। সন্ধ্যার নীরবতায় আকাশ ও সমুদ্রের সঙ্গে একাকার করে দেওয়া যায় নিজেকে। 
আন্দামানে সমুদ্র যত বিচিত্রভাবে ধরা দেয়, এমনটা বোধ হয় আর কোথাও নেই। বিজ্ঞানের সূত্র থেকে আমরা জানি পানির নিজের রং নেই। কিন্তু দুপুর রোদে ক্যারিবিয়ান কোভ বিচ থেকে দূরে তাকালে মনে হয় স্পষ্ট তিনটি রঙের স্তরে ভাগ হয়ে আছে সমুদ্রের পানি। প্রথমে হাল্কা নীল, তারপর একটু গাঢ় শেষে আরও বেশি গাঢ়। সূর্য ডুবে গেলে সব আবার একই কালচে নীল রং। আসলে সমুদ্রের গভীরতা এবং সূর্যের আলোর কারসাজিতে এমন হয়।

কোস্টাল এরিয়া অর্থাৎ তীরের অপেক্ষাকৃত কাছের সমুদ্রপৃষ্ঠে সূর্যের আলো বেশি পৌঁছায়। তাই পানি এখানে হাল্কা রঙের মনে হয়। এরপর কোরাল রিফ। কোস্টাল এরিয়া থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গভীরতা এখানে বেশি। পানিও তাই কোস্টাল এরিয়া থেকে গাঢ়। ভারতের ‘টিপ’ নামে পরিচিত কন্যাকুমারীতেও দেখেছি আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের একসঙ্গে মিলিত স্থানের পানি এ রকম আলাদা রঙে বিভাজিত। 
সমুদ্রকে নানাভাবে আবিষ্কার করতে চাইলে যেতেই হবে আন্দামানে।

×