ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

ফ্যাসিবাদ পতনের পর: ঐক্য, সরকারের চ্যালেঞ্জ ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া

প্রকাশিত: ১৫:২৯, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫

ফ্যাসিবাদ পতনের পর: ঐক্য, সরকারের চ্যালেঞ্জ ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকলের মাঝে এক অমায়িক স্বস্তির দেখা পাওয়া যায়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, সেই ঐক্য আমাদের সীমাহীন শক্তি, আমাদের পথচলার অনুপ্রেরণা। এই ঐক্য ধরে রাখা কঠিন, তবে এই ঐক্য ফিরে ফিরে আসে, দেশের প্রয়োজনে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এই ঐক্য ফিরে আসবে বলেই বিশ্বাস করি। সামগ্রিকভাবে ঐক্য ধরে রাখা এতটা সহজ কাজ হবে না বলেই মনে হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের সাথে নীতিগত, আদর্শগত, কৌশলগত পার্থক্য আছে এবং থাকবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদের প্রশ্নে সবার মধ্যে একতা থাকবে সেটাই কাম্য।

প্রথমেই একটু সরকারের প্রসঙ্গে আলোকপাত না করলে হচ্ছে না। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর, অনেক কিছুই হতে পারতো, অনেক কিছুই হওয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু হয়নি  এটাই বড় পাওয়া। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. ইউনুস সরকারের দায়িত্ব নেওয়ায় শুধু অখুশি হয়েছে সম্ভবত ফ্যাসিবাদী শক্তিই। এছাড়া পুরো দেশের সমর্থন পেয়েছে এই সরকার। এই সরকারের এগিয়ে যেতে কোনো ম্যান্ডেট নিতে হবে না। সরকার নিজেই ম্যান্ডেটের সরকার, অভ্যুত্থানই সরকারের ম্যান্ডেট। সরকারকে যে সবাই সমর্থন করে যাচ্ছে তা প্রধান উপদেষ্টার কথায়ও প্রতিফলিত হয়। তিনি বারবার একটি কথা বলছেন, আপনাদের দেখলেই সাহস পাই, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে তিনি এই কথা বলেছেন। কিন্তু সবচেয়ে যেটা প্রতিফলিত হওয়ার কথা ছিল, সেই জায়গায় সরকার গণ আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কতটা করতে পেরেছে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে, প্রশ্ন থাকাই উচিত। 

মোটা দাগে সরকারের দুইটা বড় কাজ ছিল, এখনও আছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে অভ্যুত্থানে নিহতদের তালিকা করে তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, আহতদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আর দ্বিতীয়ত ফ্যাসিবাদের সকল দোসরদের গ্রেফতার করা, বিচারের আওতায় আনা, ফ্যাসিবাদের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কলকবজা ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই দুই জায়গাতেই সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন নামে একটা সংগঠন করা হলো, সেটা নানান জল্পনা কল্পনা নানান সমালোচনা, পদত্যাগ করলেন সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। আর ফ্যাসিবাদের বিচারের প্রশ্নে সরকার উদাসীন, বরং কিছু কিছু জায়গায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। মিডিয়া সংস্কার কমিশনে এমন কিছু নাম দেখা গেছে যারা ফ্যাসিবাদের সরাসরি দোসর। সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য যাদের মতবিনিময় করতে ডাকা হয়েছে তাঁদের মধ্যেও দেখা গেছে ফ্যাসিবাদের মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা এবং স্বজনদের নাম। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানেও দেখা গেছে ফ্যাসিবাদের দোসরদের নাম। 

এই সরকার আমলাতন্ত্রের দুর্বৃত্তায়ন ঠিকভাবে ভাঙতে পারেনি। শুধু কয়েকজন আমলাকে সরিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যায় না। বড় পরিসরে আগাতে হলে পুরো সিস্টেম ভাঙতে হবে কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের দুর্বলতা দেখে ফ্যাসিবাদও বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দেওয়ার সাহস পাচ্ছে, আমাদের সবার সবচেয়ে বড় শত্রু শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য তেমন কোনো তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে সরকার ভ্যাট বাড়িয়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের উপরে নাভিশ্বাস উঠানোর অবস্থায় এনেছে। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশকে মানুষের উপর চড়াও হতে দেখা যাচ্ছে, ঠিক আগের আমলের মতোই শান্তিপূর্ণ কার্যক্রমে আঘাত করতে দেখা গেছে। আমরা দেখলাম এক উপদেষ্টা যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই হেলিকপ্টার ছাড়া যাচ্ছেন না। শীতবস্ত্র বিতরণ করতে গেছেন, কিন্তু শীতবস্ত্রের চেয়ে হেলিকপ্টারের খরচ হয়েছে আরো বেশি। আরেক উপদেষ্টাকে দেখলাম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সাথে যুদ্ধ লাগিয়েছে। কিছুর উপদেষ্টার কার্যক্রমে রাজনৈতিক আবহও দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন কমিশন অধিদপ্তরে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কিন্তু শুধু ছাত্র সমন্বয়কদের লোকজন রাখা হচ্ছে। 

ছাত্ররা একটা রাজনৈতিক দল গঠন করবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। অভ্যুত্থানের পরে ছাত্ররা উপদেষ্টা পদে গেছেন, মানুষ ভালোভাবেই নিয়েছেন, কিন্তু রাজনৈতিক দল গঠন হয়ে গেলে ছাত্রদের উপদেষ্টা পদে থাকা একদম সমীচীন হবে না। এই সামান্য কথাটিই বলেছিলেন বিএনপির মহাসচিব, কিন্তু তাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন একজন উপদেষ্টা। তাঁর এতটা আক্রমণে যাওয়ার কারণ কী ছিল কে জানে। তবে একই কথা বলেছেন জামায়াতের আমিরও। তা নিয়ে কারো কোনো হেলদোল নাই। তাহলে সমস্যা কি আসলে বিএনপির ভোট ব্যাংকে? সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, এটাই কি বিএনপির বড় দোষ! এজন্যই কি সবাই বিএনপির প্রতি বিরাগভাজন? এই ভয় কিন্তু হাসিনাও পেতো। তাই বিএনপিকে ঠেকানোর জন্য নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড় করায় উন্নয়ন। এই সরকারের কিছু উপদেষ্টা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির সুরও একই ধরনের। শুধু এখন এসেছে সংস্কার নামক শব্দ। সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে নাকি অভ্যুত্থানই ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিন্তু এই সংস্কারের আলাপ কিন্তু অভ্যুত্থানের আগে ছিল না। অথচ বিএনপি সংস্কারের আলাপ করে আসছে বহু আগে থেকেই, বিএনপি ২০১৭ সালে বিশন-২০৩০ দিয়েছে, ২০২৩ সালে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। সরকারের বিভিন্ন কমিশন থেকে যে-সব প্রস্তাব আসছে তারও অধিকাংশই এসবের মধ্য থেকেই। সংস্কারের জন্য নির্বাচন প্রলম্বিত করা নাকি তাঁদের দল গঠনের জন্য সময় নেওয়া নাকি বিএনপির ভোট কমানোর পরিকল্পনা এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

কেউ যদি আমাকে বলে যে আপনি কি রিকশায় বাসায় যাবেন নাকি আইসক্রিম খাবেন? এই প্রশ্নটা কি সঠিক? আমি তো আইসক্রিম খেতে খেতে রিকশায় করে বাসায় যেতে পারি। আইসক্রিম খাওয়া আর রিকশায় বাসায় যাওয়া একে অপরের প্রতিস্থাপক হতে পারে না, একইভাবে নির্বাচন এবং সংস্কার একে অপরের প্রতিস্থাপকও নয় সাংঘর্ষিক নয়। একইসাথে দুইটা কাজই চলতে পারে, সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া, প্রতিনিয়ত এই কাজ চলতে থাকবে। নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার করে নির্বাচন আয়োজন করবে এই সরকার, বাকি সংস্কার প্রস্তাবনা তাঁরা পরিবর্তী সরকারের জন্য রাখতে পারে। জনগণের ম্যান্ডেট থাকলে সিএ সরকার সেগুলো করবে, নাহলে তাঁরা জনগণের মতামত নেবে। কিছু কিছু সংস্কার প্রস্তাব একদম সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে, সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য একটা সংস্কার প্রস্তাব পাওয়া যাচ্ছে যেখানে দেখলাম মেম্বাররা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবে, কাউন্সিলররা মেয়র! আবার কিছুদিন আগে দেখলাম জাতীয় নাগরিক কমিটি কাউন্সিলরদের পুনর্বাসন করতে চায়, তাঁদেরকে পদে রাখতে সুপারিশ করতে চায়। এই দুই ঘটনা দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যায়। 

জাতীয় নাগরিক কমিটি বলি আর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলি, তাঁদের কার্যক্রমে সেক্যুলারিস্ট মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাঁদের কথার ধরণ হচ্ছে, দেশের জন্য, মানুষের জন্য আমরা যেটা ভাবি, যেটা বলি সেটাই সঠিক। রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যাপারটাকে সবাই স্বাগত জানায়, রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু মানুষের পালস বুঝতে হবে, আমি যেটা বলছি সেতা সঠিক এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একেক সময় একেকটা বিষয় নিয়ে তাঁরা খুব শক্ত ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করছে, আলটিমেটাম দেওয়ারও চেষ্টা করছে কিন্তু আদতে সেই কাজতা হচ্ছে না। এতে কিন্তু তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। সংবিধানের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান অন্য কেউ পছন্দ করছে না, সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার সবাই চায় কিন্তু ছুড়ে ফেলে দেওয়া ধরনের চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রক্লামেশন ঘোষণার ব্যাপারটাও তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমিয়েছে, তাঁরা চাচ্ছে কিন্তু হচ্ছে না, এটা কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাঁদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ। এখন আবার গণ পরিষদ নির্বাচনের কথাও তাঁরা বলছে। কিছু কিছু কার্যক্রমের  মাধ্যমে তাঁরা যে কিংস পার্টি হিসেবে দাঁড়াতে যাচ্ছে তার গন্ধও পাচ্ছে অনেকে। রাজনীতি করতে আসলে, ভোটের মাঠে নামলে তখন সবাই সমান, কে অভ্যুত্থানে কী করেছে এটা টানলে উলটো অভ্যুত্থানেরই স্পিরিট বিচ্যুত হবে। গণতন্ত্র আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া, গণতন্ত্রের জন্য দেশের বহু মানুষ জীবন দিয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য যেই রাজনৈতিক দলের একদম প্রধান থেকে শুরু করে লাখো মানুষের ত্যাগ রয়েছে সেই দলকে আক্রমণের মাধ্যমেই যদি কারো রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়ে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।

সরকারের উচিত ফ্যাসিবাদ দমনে আরো কঠোর থেকে কঠোরতর হতে হবে। ফ্যাসিবাদের তল্পিতল্পা সব জায়গা থেকে গুটিয়ে ফেলতে হবে। সব জায়গা থেকে ফ্যাসিবাদের লোকজন সরিয়ে ফেলতে হবে। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। নির্বাচন আয়োজনের সাথে জড়িত সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। আর আমাদের সবার দায় এই সরকারকে সহায়তা করা, এই সরকার ব্যর্থ হলে ক্ষতি আমাদের সবার, লাভ ফ্যাসিবাদের।

লেখক: মাহবুব নাহিদ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এম হাসান

×