ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১

ক্ষতিকর মাইক্রো প্লাস্টিক

আবু বকর

প্রকাশিত: ২০:৩০, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

ক্ষতিকর মাইক্রো প্লাস্টিক

আধুনিক বিশ্বে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে অনেক কিছুই তৈরি করছে। কিন্তু এসব তৈরিকৃত বস্তুই অতি ব্যবহারে একসময় মানুষের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্লাস্টিক তৈরি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক এক অতি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর এই প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রো প্লাস্টিক বর্তমানে এক নীরব ঘাতক হয়ে উঠেছে। আমরাও মাইক্রো প্লাস্টিকের ক্ষতিকর বিস্তার ও প্রভাব সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় নিজেদের অজান্তেই দেহের ক্ষতিসাধন করছি।
মাইক্রো প্লাস্টিক হলো প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণা যেটির দৈর্ঘ্য ৫ মি.মি.। অর্থাৎ ০.২ ইঞ্চির কম, যা পরিবেশ বিনষ্ট করার পাশাপাশি মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু যেমনÑ পলিথিন, বোতল বা বোতলজাত পণ্য, খাদ্য, প্রসাধনী সংরক্ষণ ইত্যাদিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার এক সাধারণ ঘটনা। যেসব পণ্যে মাইক্রো প্লাস্টিক উপস্থিত রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ঢাকায় বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার শহরাঞ্চলের জাতীয় গড় থেকে তিনগুণের বেশি যার পরিমাণ ২২.২৫ কেজি। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়, যা বাংলাদেশে উৎপন্ন বর্জ্যরে ১০ শতাংশ। আবার, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিদিন ঢাকা শহরেই সাড়ে চার কোটি পলিথিন ব্যাগ বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। এসডো আরও জানায়, যারা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেন, তাদের ওপরই বিষাক্ত রাসায়নিকের স্বাস্থ্যগত প্রভাব বেশি পড়ে। এই সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বর্তমানে মানুষ অতিশয় সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হওয়ায় প্লাস্টিকের বিকল্প মাধ্যম দেখছে না, যদিও তা পরিবেশ ও মানব দেহের জন্যসমূহ ক্ষতিকর। আবার, এসব ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য যখন পুড়ানো বা পরিবেশে ফেলে দেওয়া হয়, তখন এর থেকে নির্গত কেমিক্যাল ও ক্ষুদ্র কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। কেমিক্যাল মাটিতে মিশে যাওয়ার ফলে এর উর্বরতা হ্রাস পায়। আর ক্ষুদ্র কণাগুলো বাতাসের মাধ্যমেও বিভিন্নভাবে মানবদেহে প্রবেশ করে।
সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, প্লাস্টিক সহজে নষ্ট হয় না এবং মাইক্রো বা ন্যানো-প্লাস্টিকের কণাগুলো নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করতে পারে। গবেষণাটি আমেরিকার রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঁদুরের ওপর পরিচালিত হয়, যেখানে গর্ভবতী ইঁদুর মায়েদের শরীরে পলিঅ্যামাইড-১২ নামক প্লাস্টিকের কণা প্রবেশ করানো হয়। গবেষণার ফল বলছে, সন্তান জন্মের পরেও সেই প্লাস্টিক কণাগুলো শাবকের শরীরে উপস্থিত ছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর থেকে প্লাসেন্টার মাধ্যমে মাইক্রো প্লাস্টিক ভ্রƒণে প্রবেশ করতে পারে। মাইক্রো প্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমনÑ পেট ফুলে যাওয়া, বমি বমি ভাব, ফুসফুসে প্রদাহ, হরমোনজনিত সমস্যা, শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা, গ্যাসের সমস্যা, অ্যালার্জি সমস্যা, মানসিক সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি। এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে, যেমনÑ আহার, পান, মা থেকে শিশু, শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি।
সরকার বিভিন্নভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগগুলো নিলেও মূলত কোনো আশা ভরসা দেখা যাচ্ছে না। মানুষের প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব বুঝাতে না পাড়া, এর বিকল্প সহজ ও সাশ্রয়ী পণ্য বাজারে না পাওয়া এবং সরকারের সক্রিয় কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকার কারণে মূলত প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) এর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘যেটি আগে থেকেই নিষিদ্ধ সেটি আইনের প্রয়োগ না থাকার কারণেই বিস্তার হয়েছে এবং বর্তমানে আইনের প্রয়োগে বাধা সৃষ্টিটাও রাজনৈতিকভাবে সরকারকে অপ্রস্তুত করতে করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে তো চ্যালেঞ্জ আসবেই, কিছু সুবিধাবাদী লোকজন তো এটা করতেই চাইবে, তারপরও ক্ষতির দিক বিবেচনায় আইনের প্রয়োগ করতে হবে।’
যদি প্রতিনিয়ত মানুষ প্লাস্টিকের ব্যবহার নির্বিচারে করতে থাকে তাহলে তা এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই, সময় থাকতে এখনই সচেতন হতে হবে। সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে এবং তা সরকারকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তি, সংস্থা বা এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পণ্য যেমনÑ পাট ও কাগজ পণ্য ইত্যাদি ব্যবহার সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে প্লাস্টিক পণ্য নিষিদ্ধের আইন কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।

×