ভোল্টি (VOLTE) এর পূর্ণ রূপ হচ্ছে ‘ভয়েস ওভার লং টার্ম ইভোল্যুশন’ বা ‘ভয়েস ওভার এলটিই’। এর মাধ্যমে চতুর্থ প্রজন্মের এলটিই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ভয়েস ট্রান্সফার অর্থাৎ কল করা হয়। স্বাভাবিকভাবে সাধারণ ফোর-জি এলটিই নেটওয়ার্ক ডেটা ট্রান্সফার করতে পারলেও ভয়েস কল করতে পারে না। সেক্ষেত্রে ফোর-জি এলটিই দিয়ে ভয়েস কল করতে ভোল্টি প্রযুক্তি দরকার হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে ফোর-জি মোবাইল ও সিম দিয়ে কাউকে ভয়েস কল করলেও কলটি কিন্তু ফোর-জি ব্যান্ড দিয়ে ট্রান্সফার হয় না। কারণ আমাদের দেশে এখনো ভোল্টি প্রযুক্তি চালু হয়নি। তাহলে প্রশ্ন উঠে ভোল্টি প্রযুক্তি যদি এখনো এদেশে নাই থাকে তবে এতদিন আমাদের ফোর-জি সিম ও মোবাইল দিয়ে ভয়েস কল করলাম কীভাবে? আসলে ফোর-জি নেটওয়ার্কে থাকলেও কাউকে কল করার জন্য ডায়াল করলে আমাদের ফোন অটোমেটিক ফোর-জি ত্যাগ করে থ্রি-জিতে চলে যায়। এটি এলটিই নেটওয়ার্কের ভয়েস কল করার একটি সীমাবদ্ধতা। ভোল্টি প্রযুক্তি এসে সেই সীমাবদ্ধতাকে দূর করছে। ইতোমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোল্টির এই সেবা চালু আছে। এর বড় সুবিধা হলো যখন দুটো ভোল্টি সাপোর্টেড ফোনে একে অপরের সঙ্গে ভয়েস কলে যুক্ত থাকে তখন এইচডি কোয়ালিটির সাউন্ড পাওয়া যায়, কোনো টেকনিক্যাল নয়েজ কিংবা সিগন্যাল লস হয় না। এর কারণ হলো ভোল্টি প্রযুক্তিতে ভয়েস কলটিকে এলটিই- এর ব্যান্ড দিয়ে ট্রান্সফার করা হয়। এর আরেকটি সুবিধা হলো এর মাধ্যমে ভয়েস কলে থাকা অবস্থায়ও মোবাইল ডেটা ব্যবহার করা যায়, যা বর্তমানে থ্রি-জি কিংবা ভোল্টিবিহীন ফোর-জি নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। ফোর-জি’র সঙ্গে এলটিই বা লং টার্ম ইভল্যুশনের একটি বিশেষ যোগসূত্র আছে। ফোর-জি এলটিই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন অপারেটর চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা দিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে গ্রামীণফোন এবং বাংলাদেশে রবির ব্র্যান্ড এয়ারটেলও ভোল্টি সেবা প্রদান করছে। একটা সময় ছিল যখন টেলিফোনের মাধ্যমে তারের মাধ্যমে আওয়াজ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে যেত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, টেলিযোগাযোগ শিল্পে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করা হয় এবং তারপরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভয়েস এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছাতে শুরু করে। একে বলা হয় ভিওআইপি (VoIP) মানে ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল। প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ভোল্টির ব্যবহার । অর্থাৎ ফোর-জি বা এলটিই ব্যবহার করে যে ভয়েস কল করা যায়, সেটিকেই বলে ভোল্টি (VoLTE), বাংলাদেশের বাজারে যা একেবারে নতুন প্রযুক্তি। বর্তমান ব্যবস্থায় একজন গ্রাহক অন্য গ্রাহককে ফোন দিলে যে পদ্ধতিতে কল সংযোগ স্থাপিত হয়, তার তুলনায় এলটিই ব্যবহার করে করা ভয়েস কল অনেক বেশি দ্রুত ও শব্দ আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়। যদিও ফোর-জি ইন্টারনেটে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারেন। কিন্তু ভোল্টি (VoLTE) একজন গ্রাহকের বিদ্যমান ভয়েস কল পদ্ধতিতেই আরও উন্নত সেবা প্রদান করে থাকে। তবে নতুন এই সেবার স্বাদ নিতে হলে একটি ফোর-জি সিম থাকতে হবে, ফোর-জি ডিভাইস থাকতে হবে এবং ফোর-জি কাভারেজ আছে এমন এলাকায় অবস্থান করতে হবে। সব ফোর-জি ফোনই যে ভোল্টি ব্যবহারের উপযুক্ত, তাও কিন্তু নয়। বাংলাদেশের বাজারে থাকা মাত্র ১৬টি মডেলের ডিভাইস ভোল্টি সেবা দেওয়ার উপযুক্ত। এর মধ্যে আইফোনেরই ভিন্ন ১১টি মডেল আছে। বাকিগুলোর মধ্যে হুয়াওয়ের একটি, ম্যাক্সিমাসের তিনটি এবং স্যামসাংয়ের একটি। আইফোনের ক্ষেত্রে আইফোন সেভেন এবং এর পরের সংস্করণগুলো ভোল্টি সমর্থন করবে। ম্যাক্সিমাসের ডি-সেভেন, পি-সেভেন এবং পি-সেভেন প্লাস এই সেবা সমর্থন করবে এবং স্যামসাংয়ের জেফোর-প্লাস ও হুয়াওয়ের নোভা থ্রি-আই ফোনটি রয়েছে। শিগগিরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এই তালিকায় আরও ফোন যুক্ত হতে পারে।
এলটিই (LTE) বা দীর্ঘমেয়াদি বিবর্তন, মোবাইল ডিভাইস এবং ডেটা টার্মিনালগুলোর জন্য বেতার ব্রডব্যান্ড যোগাযোগের জন্য একটি মান। এটি পূর্ববর্তী প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তি, যেমন থ্রি-জি এর তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করে। এর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো : ১. উচ্চ গতি: এলটিই দ্রুত ডেটা স্থানান্তর হার প্রদান করে, তাত্ত্বিক সর্বাধিক ডাউনলোড গতি ৩০০ গনঢ়ং পর্যন্ত এবং আপলোড গতি ৭৫ গনঢ়ং পর্যন্ত, যদিও প্রকৃত গতি প্রায়ই কম হয়। ২. কম লেটেন্সি: এলটিই পুরনো প্রযুক্তির তুলনায় বিলম্ব কমায়, অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সময় সক্ষম করে, যা ভিডিও কনফারেন্সিং এবং অনলাইন গেমিংয়ের মতো পরিষেবাগুলোর জন্য উপকারী। ৩. অল-আইপি নেটওয়ার্ক: এলটিই একটি অল-আইপি (ইন্টারনেট প্রোটোকল) নেটওয়ার্ক হিসাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যার অর্থ ভয়েস এবং ডেটা পরিষেবা উভয়ই ডেটা প্যাকেট হিসেবে প্রেরণ করা হয়। এটি নেটওয়ার্ক সংস্থানগুলোর আরও দক্ষ ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয়। ৪. স্কেলেবিলিটি: এলটিই-এর আর্কিটেকচারটি স্কেলেবিলিটির জন্য অনুমতি দেয়, কর্মক্ষমতার উল্লেখযোগ্য অবনতি ছাড়াই ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ব্যবহারকারী এবং ডিভাইসগুলোকে মিটমাট করে। ৫. ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডস: এলটিই বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে কাজ করে, যা দেশ এবং অপারেটর ভেদে ভিন্ন হতে পারে, যা স্থাপনে নমনীয়তার জন্য অনুমতি দেয়। ৬. পশ্চাদমুখী সামঞ্জস্য: এলটিই নেটওয়ার্কগুলো পুরনো টুজি এবং থ্রি-জি নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে, নতুন প্রযুক্তিতে আপগ্রেড করা ব্যবহারকারীদের জন্য একটি মসৃণ রূপান্তরকে সহজতর করে। ৭. বর্ধিত ক্ষমতা : আরও ডিভাইসকে একযোগে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ করার অনুমতি দেয়, যানজট হ্রাস করে এবং সর্বোচ্চ ব্যবহারের সময়ে আরও ভালো কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করে। ৮. ভোল্টি (VoLTE) : এলটিই ভয়েস ওভার (এলটিই ভোল্টি) সমর্থন করে, যা এলটিই (LTE) নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভয়েস কল করার অনুমতি দেয়, উচ্চ মানের অডিও প্রদান করে এবং একই সঙ্গে ভয়েস এবং ডেটা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। সামগ্রিকভাবে, এলটিই মোবাইল ইন্টারনেট অ্যাক্সেস উন্নত করতে এবং উচ্চ-গতির ডেটা সংযোগের প্রয়োজন এমন বিস্তৃত অ্যাপ্লিকেশন এবং পরিষেবাগুলোকে সক্ষম করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ৯. বিশ্বব্যাপী গ্রহণ: বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত, বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চল জুড়ে বিরামবিহীন সংযোগ সক্ষম করে।
যদিও এটিকে প্রায়ই ফোর-জি এলটিই হিসেবে উল্লেখ করা হয়, এটি মূলত প্রযুক্তিগত মান অনুসারে সত্য ফোর-জি হিসাবে বিবেচিত হয়নি। যাইহোক, থ্রি-জির ওপর এর উল্লেখযোগ্য উন্নতিগুলো চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির সঙ্গে এর সম্পর্ককে সিমেন্ট করেছে। তবে প্রযুক্তিভিত্তিক অন্যান্য জনপ্রিয় সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ভয়েস কোয়ালিটি, দ্রুত কল কানেক্ট করার ক্ষমতা। ২. উচ্চ মানের ভয়েস কল (HD Voice): ভোল্টি’র মাধ্যমে ভয়েস কলের মান অনেক উন্নত হয় এবং পরিষ্কার শোনায়। ৩. ফাস্ট কল কানেকশন: ভোল্টি কলের কানেকশন টাইম ফোর-জি’র মাধ্যমে দ্রুত হয়। ৪. ডাটা এবং কল একসঙ্গে: ভোল্টি প্রযুক্তির মাধ্যমে কল করার সময় ডাটা ব্যবহার করার সুযোগ আছে। ৫. লম্বা ব্যাটারি ব্যাকআপ: ভোল্টি-তে কল করার সময় ব্যাটারির কম খরচ হয়, কারণ এটি শক্তিশালী প্রযুক্তি। ৬. ভিডিও কল সুবিধা: ভোল্টি সমর্থিত ফোন এবং নেটওয়ার্কে সরাসরি ভিডিও কল করা যায়। ভোল্টি (VoLTE) এর পাশাপাশি ভিওএনআর (VoNR) সেবাও বিদ্যমান। ভিওএনআর মানে ভয়েস ওভার নিউজ রেডিও। এটি ভিওআইপির সর্বশেষ সংস্করণ যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কথা বলার সর্বশেষ সংস্করণ, যা ফোর-জি এর চেয়ে ভালো মানের কল এবং ইন্টারনেট গতি প্রদান করে। তবে শুরুতে ভয়েস কলের এই সুবিধাগুলো ছিল জিপিআরএস (GPRS) এর মাধ্যমে, যা টু-জি এবং থ্রি-জি সেলুলার যোগাযোগ ব্যবস্থাতে প্যাকেটভিত্তিক ওয়্যারলেস ডেটা যোগাযোগ পরিষেবা হিসেবে জনপ্রিয় ছিল।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়