বাঙালির প্রধান খাদ্যশস্য চাল তথা ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণার ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন ধানের বিভিন্ন জাত আবিষ্কারেÑ একথা অস্বীকার করা যাবে না। যে কারণে জনসংখ্যাবহুল দেশটির খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে বহুলাংশে। এর পাশাপাশি পূরণ হচ্ছে দৈনন্দিন পুষ্টির চাহিদা। বাকৃবির বিজ্ঞানীরা এবার উদ্ভাবন করেছেন পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ রঙিন ধান তথা চাল। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ছোলায়মান আলী ফকির, কো-পিআই অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন-২ এবং তাদের সহায়তাকারী দুজন শিক্ষার্থী রঙিন চাল উদ্ভাবনের বিষয়ে কাজ তথা গবেষণা করেছেন নিরলসভাবে। যথারীতি এর সুফলও পাওয়া গেছে। রঙিন চাল নিয়ে প্রধান গবেষক ড. ছোলায়মান আলী ফকির বলেন, রঙিন চালের পুষ্টিগুণের কারণে স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রমশ। বর্তমানে পাহাড়ি অঞ্চল এবং প্রগতিশীল কৃষক চাষাবাদ করছেন রঙিন ধানের।
রঙিন চালের ধানের রং সোনালি, লাল, কালো অথবা বেগুনি হতে পারে। চালের রং হয় লাল, বেগুনি, বাদামি বা কালো। খোসা ছাড়ানোর পর এই চালের দানা বাইরে থেকে কালো বা লাল বহিস্থ আবরণ দ্বারা সজ্জিত থাকে, যাকে বলা হয় ব্রান। সাধারণ সাদা চালের তুলনায় এই চাল অধিক প্রোটিন, ভিটামিন ও আঁশসমৃদ্ধ। তদুপরি ঔষধি গুণে ভরপুর। রঙিন চালের ব্রানে প্রোটিন ও আঁশের পরিমাণ বেশি, যা ডায়াবেটিস ও স্থ’ূলতা প্রতিরোধ করে। কালো চালে বিদ্যমান একটি রাসায়নিক পদার্থ এন্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ, যা মানুষের দেহের ক্ষতিকর পদার্থগুলো বিশোধন করে। রক্তচাপ, হৃদরোগ ও রক্তে কোলেস্টেরল কমাতে সহায়ক। প্রধানত আমন মৌসুমের হলেও বোরো মৌসুমেও এটি আবাদ করা যায়। কালো চাল দিয়ে ভাত, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, চিড়া, মুড়ি, পিঠাসহ প্রায় সবই তৈরি করে খাওয়া যায়। ফলে, একই সঙ্গে দৈনন্দিন খাদ্য উপাদান ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তবে রঙিন ধানের আবাদে প্রয়োজনীয় পরিমিত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ফলে, উৎপাদন খরচ পড়ে বেশি। ফলনও হয় কম। তবে চালের দাম প্রতিকেজি ১শ’ থেকে দেড় শ’ টাকা হওয়ায়, কম ফলনেও পুষিয়ে যায় কৃষকের। স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও খুবই উপকারী।
ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ধানের পাঁচটি নতুন জাত বা প্রজাতির উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন, যেগুলোর একর প্রতি ফলন ক্ষমতা বেশি, চাল সরু, সুগন্ধি ও উন্নতমানের। নতুন প্রজাতিগুলো হলো- ব্রি-ধান ৮৮, ব্রি-ধান ৮৯, ব্রি-ধান-৯২, ব্রি-ধান ৯৬ এবং বঙ্গবন্ধু ধান-১০০। এসব প্রজাতির ধানের ফলন সর্বনিম্ন ২৮ মণ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ মণ। রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, উচ্চফলনশীল। মূলত ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাত দুটি তিন দশকের পুরনো হয়ে যাওয়ায় এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। কৃষি বিজ্ঞানীরা চাইছেন পুরনো জাতগুলো প্রত্যাহার করে নতুন উচ্চফলনশীল জাতের চাষাবাদ মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে। যেমনÑ বিনা-২৫ জাতের ধান প্রথম আবাদেই বাজিমাত করেছে মাঠ পর্যায়ে উচ্চফলন ও উন্নতমানের ধান-চাল উৎপাদনের কারণে। চাল সরু ও সুগন্ধি বাসমতিতুল্য। ব্রি-র বিজ্ঞানীরা এও বলেছেন যে, নতুন প্রজাতির ধান যে অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগী, সেই এলাকার জাত দেবেন কৃষককে চাষাবাদের জন্য। ব্রি-র বিজ্ঞানীদের কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে আরও কয়েকটি নতুন প্রজাতির ধান, যা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সৃজনশীল উদ্ভাবন রঙিন ধান এক্ষেত্রে যোগ করল আরও একটি নতুন মাত্রা, যা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় হবে উপকারী।