ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১

লন্ডনের চিঠি

চ্যাটজিপিটি কি ‘নিউ নর্মাল’

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২০:৩১, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

চ্যাটজিপিটি কি ‘নিউ নর্মাল’

এই টার্মে আমার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের একটি ছোট রিসার্চ পেপার লিখতে বলা হয়েছে। রিসার্চের বিষয়টি তারা নিজেরা ঠিক করবে। টাইটেল ঠিক হয়ে গেলে সেটা আমার কাছে জমা দেবে। আমি যদি বলি, হুম ঠিক আছে, তবে চার সপ্তাহের মধ্যে ঐ বিষয়ে একটি ক্ষুদ্র রিসার্চ পেপার জমা দিতে হবে তাদের। মূল উদ্দেশ্য- কোনো একটি বিষয়ে কিভাবে বর্তমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয়, ভুল এবং শুদ্ধ তথ্যকে আলাদা করতে জানতে হয়, তথ্য-উপাত্তের উৎসকে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করতে হয় ইত্যাদি। এক কথায়- আয়তন ও আকার হিসেবে ছোট হলেও একটি রিসার্চ পেপারের গড়ন, গঠন, প্রক্রিয়া এবং উপাদান-  সবই এর মধ্যে দেখাতে হবে। আমি পুরো প্রক্রিয়াটা তাদের কাছে ব্যাখ্যা করলাম। একটা দীর্ঘ ক্লাস নিলাম কীভাবে সার্চ ইঞ্জিনকে (যেমন : গুগুল) একটু বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করলে সেটা অপ্রয়োজনীয় লিংকগুলোকে সরিয়ে রেখে দরকারি লিংকগুলোকে আগে দেখায়। দেখালাম, কিভাবে এসব লিংকগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়।
আরেকটা ক্লাসে ব্যাখ্যা করলাম, কেন আমরা চাইলেই যে কারও লেখা স্রেফ কপি-পেস্ট করতে পারি না। দেখালাম, কোনো লেখা  বা তথ্য কোনো জায়গা থেকে নিলে কিভাবে রেফারেন্সসহ তার কৃতিত্ব যথোপোযুক্ত লেখককে দিতে হয়। এভাবে রিসার্চ পেপার লেখার এসব খুঁটিনাটি বিষয় অত্যন্ত যত্ন সহকারে শেখানোর পর তাদের লেখা শুরু করতে বলা হলো। অতি আশ্চর্যের বিষয়: মাত্র দুদিনের মাথায় পাঁচজন শিক্ষার্থী তাদের রিসার্চ পেপার নিয়ে হাজির আমার দরজায়। বেশ কয়েক হাজার শব্দের সুন্দর টাইপ করা ডকুমেন্ট। আমি অতি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- শেষ? তারা মুখে দিগি¦জয়ী হাসি দিয়ে বলল, জ্বি। ভাবখানা এমন, এ আর এমন কী! নিজের বিস্ময় আর বাড়তে না দিয়ে ওদেরকে বেশ প্রশংসা করে বিদায় নিলাম। তারপর একটু ফুরসত পেতেই ওদের ডকুমেন্টগুলো খুলে পড়তে শুরু করলাম।
পড়তে পড়তে রীতিমতো চমৎকৃত হলাম। অতি চমৎকার ঝরঝরে ভাষায় লেখা ডকুমেন্ট। নিখুঁত ইংরেজি, দারুণ বাক্যগঠন, সুন্দর প্যারাগ্রাফ, যথোপযুক্ত শিরোনাম। দীর্ঘ রেফারেন্স আছে শেষে। সেগুলো ক্লিক করেও খানিকটা ঘেঁটে দেখলাম, নাহ, সবই তো ঠিক ঠাক। কিন্তু খটকা যায় না সহজে। মাত্র দুইদিনে এমন ডকুমেন্ট তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। খানিক সন্দেহ হলো। তবে কী! যা ভেবেছিলাম, তাই। এআই দিয়ে লেখা কী না, সেটা বিশেষ একটা সফটওয়্যারে চেক করতেই সফটওয়্যার জানান দিল- তিনটি লেখার অন্তত ৯০ ভাগ এআই জেনারেটেড। বাকি দুটোর ৭৫ শতাংশ। বিশেষ মিটিংয়ে ডাকলাম ওদের। আমাকে খুব বেশি কথা ব্যয় করতে হলো না। তিনজনই নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিল, তারা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে রিসার্চ পেপার লিখেছে।
সমস্যার নিরূপণ এ পর্যায়ে এসে থামতে পারতো। কিন্তু আমি আরও অবাক হলাম, যখন দেখলাম, ওদের কাছে চ্যাট জিপিটি ব্যবহার করে ডকুমেন্ট লেখাটা খুব একটা দোষের কিছু বলে মনে হচ্ছে না। পরদিন ক্লাসে পূর্ব নির্ধারিত টপিক বাদ দিয়ে আমি চ্যাট জিপিটির ব্যবহার বিষয়ে এ কালের ছাত্র-ছাত্রীদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এ বিষয়টি উত্থাপন করলাম। ঐ পাঁচজন ছাত্রছাত্রীর নাম না উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করলাম, রিসার্চ ডকুমেন্ট লেখায় ব্যাপারে চ্যাটজিপিটির ব্যবহার বিষয়ে কার কী অভিমত? যা উত্তর পেলাম, তা হতাশার। দেখলাম, অর্ধেকেরও বেশি ভেবে নিয়েছে, এতে সমস্যার কিছু নেই। বাকিরা বলছে, চ্যাট জিপিটি ব্যবহার করা যায়, তবে খানিকটা মনুষ্য- ছোঁয়া রাখতে এখানে-ওখানে পাল্টে দেওয়া উচিত। তাদের মতে, এটি আরেকটি টুল, অসুবিধা কী! ওদের এই মনোভাবের বিপরীতে যে দীর্ঘ লেকচার আমি দিয়েছি, তা বোধকরি কেউ পড়তে চাইবেন না, তাই সে প্রসংগে যাচ্ছি না। এরপরে যা করলাম, তা হলো- ২০০ জন ছাত্রছাত্রীর মাঝে একটা খুব ছোট্ট সার্ভে করলাম। গুগল ফর্ম ব্যবহার করে তাদের অল্প কয়েকটি প্রশ্নে চ্যাটজিপিটির ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বিশেষ করে জানতে চাইলাম, তারা কি এটাকে মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশে কোনো বাধা হিসেবে দেখে কি না? যে ফল পাওয়া গেল, তার অতি সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে- ১৭৫ জন ছাত্রছাত্রী মনে করে এটা গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের মতোই আরেকটি সার্ভিস। জিনিসটা যখন ‘ফ্রি, অ্যান্ড এভেইলএবেল‘, তবে এত কষ্ট করে নিজে নিজে কোনো কিছু করার দরকার কী!
পদার্থ বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন- এমন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হয়েছিল বহুদিন আগে। আমি নিজেও পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। তবে ভদ্রলোক মাস্টার্স পাস করেছেন অনেক দিন আগে, আমি যে বছর জন্ম নিয়েছি, সে বছর। কথায় কথায় আমাকে বললেন, তাদের সময় স্বভাবতই কোনো ক্যালকুলেটর ছিল না। যার ফলে পদার্থ বিজ্ঞানের বিশাল বিশাল সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে তাদের দিনের পর দিন লেগে যেত। নিছক একটি সংখ্যার লগ বের করতেই কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যেত। আমি তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান হিসেবে ভেবে নিয়ে ভাবলাম, সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে কয়েক সেকেণ্ডেই কাজটা করে ফেলতাম আমরা। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এতে আমাদের সময়কার ছাত্রছাত্রীদের সময় বেঁচেছে কি-না, সে তর্ক না তুলেও এটা মেনে নিতেই হবে, আমরা কেউই ঠিক আসলে লগারিদম বের করার ধাপগুলো কখনোই খুব ভালো করে শিখতে পারিনি। দুটো বাটন টিপলেই যদি উত্তর বের করা যায়, তবে কে আর অত কষ্ট করে বিষয়টি শিখতে যায়।
একেকটি প্রযুক্তি আসে, আর জীবনযাত্রা সহজ হয়ে পড়ে - এ কথাতো অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে অন্য যে কোনো প্রযুক্তির সঙ্গে চ্যাটজিপিটির বিশেষ কিছু পার্থক্য আছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমার ভাবনা ভবিষ্যতে কখনো প্রকাশ করার ইচ্ছে জানিয়ে রেখে আপাতত মানতেই হচ্ছে, সময়টা এখন চ্যাটজিপিটির। লন্ডনের ক্লাসরুমগুলোতে আমরা এখনো এ জিনিস ব্যবহার  করতে দেই না। কিন্তু এধারা কতদিন ধরে  রাখা যাবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ছোট ক্লাস থেকে বড় ক্লাস, সুযোগ পেলেই বাচ্চারা নিজেদের হোম ওয়ার্কসহ নানান কাজে একে অবাধে ব্যবহার করছে। সবচেয়ে বড় দুর্যোগ, এর ব্যবহার হয়ে পড়ছে ‘নিউ নর্মাল‘ ওদের কাছে। আমার শিক্ষকরা যতই মস্তিষ্ক- পেশীর অপব্যবহারে তার অকার্যকর হয়ে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন না কেন, সে শঙ্কাটি খুব কম শিক্ষার্থীই আমলে নিচ্ছে, সে আমি প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি।  চ্যাটজিপিটির যে প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, তার পুরো প্রভাব বুঝতে আমাদের আরও বেশ কিছু সময় লেগে যাবে। তবে আশঙ্কার কারণ যে আছে, আপাতত সেটা জানিয়ে রাখছি।
২৩ জানুয়ারি ২০২৫

×