‘জলবায়ু’ শব্দটা ব্যাপক পরিচিত হলেও অনেকেই শব্দটার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেননি। বিষয়টি বোঝেন কিন্তু বোঝাতে সক্ষম নন। জলবায়ুর ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট হিসেব-নিকেশ আছে অবশ্য। হিসেবটি জানানোর আগে আমরা জেনে নেই জলবায়ুর উপাদানসমূহ। যেমনÑ বায়ু, বায়ুচাপ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মেঘ-বৃষ্টি, তুষারপাত, আগ্নেয়গিরির অগ্নুুৎপাত ইত্যাদি জলবায়ুর উপাদান। আর ছোট্ট হিসেবটি হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের ২৫-৩০ (মতান্তরে ১০-১২) বছরের গড় আবহাওয়াই হচ্ছে জলবায়ু। অর্থাৎ, দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পরিবর্তনটাই হচ্ছে মূলত জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনকে আমরা সাধারণত ‘জলবায়ু সংকট’ বলে থাকি। এছাড়াও আবহাওয়ার মতো জলবায়ুর উপাদানসমূহ নিয়ন্ত্রিত হয় অক্ষাংশ, ভূপৃষ্টের উচ্চতা, বনভূমি, ভূমির ঢাল, পর্বতের অবস্থান, সমুদ্র থেকে দূরত্ব, সমুদ্রস্রোত, বায়ুপ্রবাহের দিক, মাটির বিশেষত্ব ইত্যাদির মাধ্যমে। এই নিয়েই তৈরি হয় জলবায়ু সংকট। যার ফলেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে; বৈজ্ঞানিক ভাষায় যাকে ‘গ্রিনহাউস’ প্রতিক্রিয়া বলা হয়। সর্বসাধারণের কাছে সেটি বৈশ্বিক উষ্ণতা নামেও পরিচিত।
জলবায়ুর প্রভাবের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ২০২৪ সালের বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। অন্যান্য বছরের তুলনায় গত বছরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছিল। উপমহাদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপক তাপমাত্রা বিরাজ করছিল গত বছর। এসব ঘটছে শুধু জলবায়ু সংকটের প্রভাবেই। বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙনের বিষয়টিও জলবায়ু সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জলবায়ু সংকটের কারণে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন, তেমনি সেসব ঘূর্ণিঝড়গুলো খুব শক্তিশালী হয়ে উপকূলে আঘাতও হানছে। এছাড়াও জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির বিষয়টি আশঙ্কা জাগিয়েছে আমাদের। যে কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে চাষাবাদে যেমন বিঘ্ন ঘটছে, তেমনি চিংড়ি চাষে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে এসেছে। আবার অতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, গাছ-গাছালি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে নিম্নাঞ্চলগুলোতে। এ ভয়ংকর দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে শুধু একটি কারণেই, আর সেটি হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ু সংকটের জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশেগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা। সেই দেশগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার খেসারত দিতে হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এখন। তারা একদিকে কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে জলবায়ু সংকটের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে অনুদানও দিচ্ছে। অনেকটা গোড়া কেটে জল ঢালার মতো। যার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে, আমাদের অনুদানের প্রয়োজন নেই, আমরা অনুদান চাই না, আমরা চাই কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসুক। আমরা চাই, আমাদের প্রাণপ্রিয় সুন্দরবন টিকে থাকুক। টিকে থাকুক দক্ষিণ এশিয়ার গর্ব হিমালয় পর্বতমালাও।
সমীক্ষায় জানা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়ের বরফও গলে যাচ্ছে দ্রুততর। দুই দশকের তুলনায় হিমালয়ের বরফ দ্বিগুণ হারে গলছে! তাতে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ এশীয় অঞ্চলের শতকোটি মানুষ বিশুদ্ধ জল সমস্যায় পড়বে। বিশুদ্ধ জলের পরিমাণ তো এমনিতেই সীমিত। সমগ্র বিশ্বে মোট মজুত জলের পরিমাণ ১.৩৮৬ বিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার। তার মধ্যে সমুদ্রে সঞ্চিত লবণাক্ত জলের পরিমাণ ৯৭.২ শতাংশ। যা মোটেও পানযোগ্য নয়। অন্যদিকে ২.১৫ শতাংশ জল জমাটবদ্ধ হয়ে আছে বরফাকারে। সেটিও নয় পানযোগ্য। বাকি .৬৫ শতাংশ জল সুপেয় হলেও প্রায় .৩৫ শতাংশ জল রয়েছে ভূগর্ভে। যা উত্তোলনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পানযোগ্য জল চাহিদা পূরণ করতে হয়। এই জল আমাদের কাছে বিশুদ্ধ জল হিসেবে পরিচিত। এই জলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে প্রতিটি মানুষের জন্য দৈনিক গড়ে ৩ লিটার হারে। ভূগর্ভস্থ জল ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা পুকুর-জলাশয়ের জল সুপেয় হলেও তা বিশুদ্ধ নয়। তবে সেটিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে গোসলাদি, রান্না-বান্না, জামা-কাপড় ধোয়ার কাজে এ জলের ব্যাপক প্রয়োজন পড়ে। তাতে করে একজন মানুষের সব মিলিয়ে গড়ে ৪৫-৫০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়।
বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের মোট আয়তনের তিনভাগ জলরাশি হলেও বিশুদ্ধ জল সংকটে ভুগছেন ৮০টি দেশের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ। এ ছাড়াও প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে শুধু দূষিত জল পান করে। বিশুদ্ধ জলের অভাবের নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া এবং আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই বিশ্বের ১৪৫ কোটি মানুষ সুপেয় জল সংকটের মুখোমুখি হবে। তার মধ্যে এশিয়া মহাদেশে ১২০ কোটি এবং আফ্রিকা মহাদেশে ২৫ কোটি মানুষ এর আওতায় পড়বে। এ থেকে বাদ যাবে না বাংলাদেশের মানুষও। বরং তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ বেশি জল সংকটে পড়বে। এছাড়াও অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশীয় অঞ্চলে প্রভাব পড়বে খানিকটা বেশি। তার ওপর আমাদের জন্য মহা অশনি সংকেত হচ্ছে হিমালয়ের বরফ গলার হার দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়া। যেখানে বিগত দুই দশকে ৫০ সেন্টিমিটার বরফ গলেছে, সেখানে দ্বিগুণ হারে বরফ গলছে বর্তমানে। হিমবাহ গবেষকদের অভিমতÑ এই হারে বরফ গলতে থাকলে এশিয়ার কয়েকটি দেশের ১০০ কোটি মানুষ সরাসরি বিশুদ্ধ জল সমস্যায় ভুগবে। এই দুর্যোগ থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন গবেষকরা। তারা স্পষ্ট বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। তাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ হবে। উষ্ণতা রোধ না হলে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে গ্রহান্তরিত হতে হবে মানবজাতিকে। সুতরাং বুঝে নিতে হবে কোন্টি আমাদের জন্য সহজ, গ্রহান্তরিত, না কী কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামানো!
প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, শিল্পোন্নত দেশের বলির পাঁঠা সল্পোন্নত দেশগুলো কেন হতে যাবে! বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য বিশ্ব বিবেকের কাছে আমাদের আবেদনও রইল। বিষয়টি নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান জানাই। কারণ, এসব নিয়ে ভাবাভাবি কিংবা লেখালেখি, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের সময় এখন আর নেই। সেই সময় ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। যা করার দ্রুতই করতে হবে এখনই। কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনে মানব সভ্যতার জয়জয়কার ছড়িয়ে দিতে হবে। সুতরাং মুখে মুখে নয়, তা বাস্তবায়ন করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিতে হবে মোড়ল দেশগুলোকে। তাহলেই সার্থক হবে তাদের মোড়লিপনা। অন্যথায় এশিয়ার শতকোটি মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশকর্মী