দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল এবং সে কারণেই মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা খুবই জরুরি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। ১৭ কোটি মানুষের প্রতিদিনের হিসাব ধরে বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টন চাল। শুধু ভাত হিসেবে এ চাল মানুষ গ্রহণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন পোলট্রি ফিড, বীজসহ অন্যান্য প্রয়োজনে চাল ব্যবহার হয় আরও এক কোটি টন। সব মিলিয়ে প্রয়োজন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। কিন্তু গত বছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টন। তারপরও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি আমন মৌসুমে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বন্যায় কিছু এলাকার জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে ফের আবাদ করা যায়নি। এতে আবাদ হওয়া ৫৬ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ৫৩ লাখ হেক্টরের ধান কাটা হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ টন ধান, যদিও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ টন। তবে সে তুলনায় এবার উৎপাদন কম হয়নি। তারপরও চালের ক্রমাগতভাবে মূল্যবৃদ্ধি কেড়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বস্তি যা কাম্য নয়।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানি বৃদ্ধি, ভর্তুকি মূল্যে বিক্রিসহ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও কাজে আসছে না কিছুই। এক মাস ধরে দাম বেড়েই চলেছে দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের। এই সময়ে কেজিতে সর্বোচ্চ ১০ টাকা পর্যন্ত দর বেড়েছে চালের। চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সরকার আমদানি উদারীকরণের নীতিতে যাচ্ছে জানিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমদানি উদার করতে গভর্নর, খাদ্য উপদেষ্টা, টিসিবি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতিতে আপাতত আমদানিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিপুল চাল আমদানির প্রস্তুতি চলছে। এতে স্থানীয় বাজারে দাম কমবে।’ এক মাসের ব্যবধানে ডিসেম্বর ৬৪৫ শতাংশ বেড়েছে চালের আমদানি। আর বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩১ হাজার ৩২৬ শতাংশ। এরপরও বাজারে অস্থিরতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ৫৫ হাজার ৯৩৯ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। আগের মাস নভেম্বরে চাল আমদানি হয়েছিল মাত্র ৭ হাজার ৫০৭ মেট্রিক টন। অর্থাৎ, এক মাসের ব্যবধানে চালের আমাদানি বেড়েছে ৬৪৫ শতাংশ। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে চাল আমদানি হয়েছিল মাত্র ১৭৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে চালের আমদানি বেড়েছে ৩১ হাজার ৩২৬ শতাংশ। এরপরও বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ভারত থেকে আরও ৫০ হাজার টন নন-বাসমতী সেদ্ধ চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায়। প্রতিকেজি চালের মূল্য ধরা হয়েছে ৫৫ টাকা ৬ পয়সা। প্রতি টন ৪৫৮ দশমিক ৮৪ ডলার দরে ভারতের বাগাদিয়া ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে এ চাল আমদানি করা হবে। এতে সরকারের ব্যয় হবে ২৭৫ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর একই প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতী সেদ্ধ চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ওই লটে প্রতিকেজি চালের দাম ধরা হয় ৫৪ টাকা ৮০ পয়সা। সম্প্রতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে ও জনস্বার্থে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ৬ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ।
এরই মধ্যে চালের মূল্যে আমদানি নির্ভরতার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে । সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ভারত ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। কিছু চাল ইতোমধ্যে দেশে এসেছে, কিছু চাল আমদানির পথে রয়েছে। নতুন করে পাকিস্তান থেকেও চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির কারণে কয়েক সপ্তাহ ধরে চালের চড়া বাজারে দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। মানভেদে কেজিতে কমেছে দু-এক টাকা। তবে এখনও আগের অবস্থায় ফেরেনি চালের বাজার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েকটি দেশ থেকে আমদানির কারণে মজুতদাররা নড়েচড়ে বসেছেন। তারা দর কিছুটা কমাতে শুরু করেছেন। এর প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারেও। চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে ৭ জানুয়ারি ভারত থেকে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি চাল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। এ ছাড়া গত ২৫ ডিসেম্বর ভারত থেকে আসে ২৪ হাজার ৬৯০ টন সেদ্ধ চাল। ১২ জানুয়ারি আসে ২৬ হাজার ৯৩৫ টন চালের আরেকটি চালান। পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও ভারত থেকে চাল আসছে। ভারতের পর মিয়ানমার থেকেও চাল এসেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে ২২ হাজার টন আতপ চাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে এমভি গোল্ডেন স্টার জাহাজ। জিটুজি ভিত্তিতে এসব চাল আনা হয়। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা চালের প্রথম চালান। জাহাজে রক্ষিত চালের নমুনা সংগ্রহ করে ভৌত পরীক্ষা শেষে দ্রুত খালাসের কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া নতুন করে পাকিস্তান থেকেও চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ১৬ জানুয়ারি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন আতপ চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। একই বৈঠকে ভারত থেকেও ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন পায়।
গত ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর কারওয়ান বাজার, তেজকুনিপাড়া এবং মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরায় প্রতিকেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮৮ টাকা। এর আগের সপ্তাহে যা ৮০ থেকে ৯০ টাকা ছিল। আগের সপ্তাহে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া মিনিকেট চাল কেনা যাচ্ছে ৭৬ থেকে ৮০ টাকায়। এ ছাড়া ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হওয়া মোটা বা স্বর্ণা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা দরে। আর মাঝারি বা বিআর-২৮ জাতের চালের কেজি আগের মতোই বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে খাদ্য মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আট লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা করেছে। এজন্য সংশোধিত বাজেটে অর্থ বিভাগের কাছে অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
এদিকে চাল আমদানির খবর মজুতদার ও মিলারদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এজন্য চালের দর কিছুটা কমতির দিকে বলে জানান খুচরা ব্যবসায়ীরা। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি মূল্যে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে । খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওএমএসের আওতায় সারাদেশে ১ হাজার ৭৫২টি বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে দৈনিক ১ হাজার ৭৫২ টন চাল বিক্রি করা হবে। প্রতিকেজি ৩০ টাকা দরে প্রত্যেক ক্রেতা পাঁচ কেজি করে চাল কিনতে পারবেন। প্রথম পর্যায়ে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
সরকার আমন ধান ও চাল সংগ্রহ শুরু করেছে ১৭ নভেম্বর থেকে। চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আতপ চাল সংগ্রহ করা হবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। এবার ধান সংগ্রহ করা হবে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন, সেদ্ধ চাল ৫ লাখ ৫০ হাজার টন ও আতপ চাল এক লাখ টন। মোট সংগ্রহ ১০ লাখ টন। ধানকে চাল হিসেবে বিবেচনায় ধরে মোট চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৮ লাখ ৮০ হাজার টন, যা সম্ভাব্য মোট চাল উৎপাদনের প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিকেজি ধান ৩৩ টাকা, সেদ্ধ চাল ৪৭ ও আতপ চাল ৪৬ টাকা। কয়েক বছর ধরেই ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। এবার যেহেতু আমনের ফলন কম হয়েছে, তাই সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করাও কঠিন হবে। চালের বাজারের অস্থিতিশীলতা কমাতে সরকারকে আমদানির মাধ্যমে সরকারি মজুতের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। ফলন কম হওয়ায় কৃষকরাও চাল মজুত করবেন। পাশাপাশি আড়তদার ও মিল মালিকরাও চাল মজুত করবেন। এতে বাজারে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট প্রকট হবে। তাই আগের বাজার পর্যালোচনা করে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকারকে আমদানির মাধ্যমে চালের মজুত বাড়াতে হবে। উল্লেখ করা দরকার, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্যসম্পর্কিত নীতি প্রণয়নে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি মজুতের পরিমাণ জানা গেলেও বেসরকারি খাতে চালের মজুত কত আছে, তার কোনো পরিসংখ্যান জানা নেই। এ সম্পর্কিত তথ্য প্রথমে সংগ্রহ করতে হবে। সঠিক তথ্যের মাধ্যমে ঘাটতি নির্ণয়পূর্বক আমদানি করতে হবে। সরকার শুল্ক কর তুলে নিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। যদিও এটি দিয়ে মজুত পরিস্থিতির খুব উন্নতি করা যাবে কিনা এবং বাজারে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে ঠিক কী পরিমাণ চাল আমদানি করা প্রয়োজন, তা নিরূপণ করা জরুরি। বিশ্ববাজার ও স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় আমদানির মাধ্যমে চালের মজুত বৃদ্ধির পাশাপাশি চালের বাজারের অস্থিরতা রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, এটিই প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা