ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১

গণহত্যা বন্ধে বৈশ্বিক দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির তাগিদ

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:১৪, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

গণহত্যা বন্ধে বৈশ্বিক দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির তাগিদ

প্রতিবছর ২৭ জানুয়ারি, বিশ্বের মানুষ হলোকাস্টের শিকারদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে আন্তর্জাতিক স্মরণ দিবস পালন করে। এটি মানব ইতিহাসের একটি শোকাবহ ও ভয়াবহ অধ্যায়কে প্রতিফলিত করে। হলোকাস্ট ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানি ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ইহুদি এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর পদ্ধতিগত হত্যা। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ছয় মিলিয়ন ইহুদিসহ রোমা জনগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, রাজনৈতিক বিপক্ষবাদী এবং নাৎসি মতাদর্শের বিরোধীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এটি মানবজাতির নিষ্ঠুরতার এক ভয়ংকর উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এমন বর্বরতা কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ইতিহাসের এই করুণ শিক্ষা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের পথ প্রদর্শক হওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এমন গণহত্যার পুনরাবৃত্তি না হয়। যদিও গাজার গণহত্যার মতো ঘটনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ সীমিত করে দেয়, তবু আশা জিইয়ে রাখা জরুরি। হলোকাস্টের ভয়াবহতা স্মরণ করতে গিয়ে আমাদের বিশ ও একুশ শতকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গণহত্যা পর্যালোচনা করাও প্রয়োজন।

১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির
বিরুদ্ধে গণহত্যা
বিশ শতকের সবচেয়ে উপেক্ষিত গণহত্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং নৃশংসতম একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জনগণের ওপর যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল, তাতে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ আহত ও নির্যাতনের শিকার হয় (বিশেষত নারী) এবং কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। তবু, সেই সময় বিশ্ব প্রায়ই হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছিল বা সহিংসতার প্রকৃত মাত্রা স্বীকার করেনি। এখনও এই গণহত্যা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথাযথভাবে স্বীকৃতি পায়নি, যা দুঃসাধ্য।
এই গণহত্যা শুরু হয়েছিল যখন বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক সরকারের কাছ থেকে স্বাধীনতা দাবি করে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি জনগণের চাহিদা ও আকাক্সক্ষাকে উপেক্ষা করেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং দ্রুত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু হওয়া ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলন দমন এবং সম্ভাব্য প্রতিরোধ নির্মূলের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। এই অভিযানের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালায়, যেখানে সাধারণ নাগরিক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। সহিংসতার মাত্রা ছিল চরম ভয়াবহ, যার মধ্যে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং গ্রাম ধ্বংসের মতো নারকীয় কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই গণহত্যা কেবল যুদ্ধের অনিবার্য ফল ছিল না; এটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি একটি সুপরিকল্পিত আক্রমণ। এই আক্রমণের মধ্যে ছিল সাধারণ মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা, বাঙালি হিন্দু সংখ্যালঘুদের বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা এবং নারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক যৌন সহিংসতা চালানো। নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাত্রা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মনোযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। যুক্তরাষ্ট্র, যাদের পাকিস্তানের সঙ্গে শক্তিশালী কৌশলগত সম্পর্ক ছিল, ইসলামাবাদের শাসকগোষ্ঠীকে উল্লেখযোগ্য সামরিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছিল এবং চলমান নির্যাতনকে কার্যত উপেক্ষা করেছিল। অন্যদিকে, ভারত সরকার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রভূত সহায়তা করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আজও ১৯৭১ সালের গণহত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে অমলিন রয়ে গেছে। অনেক বেঁচে থাকা ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য এখনও এই নৃশংস ঘটনাকে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক দায়িত্ব ও স্বীকৃতির অভাব এই ট্রমাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, যা বাংলাদেশের জনগণের সম্মিলিত স্মৃতিতে গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্বীকৃতি শুধু ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার একটি প্রচেষ্টা নয়, এটি ভবিষ্যতে এমন গণহত্যার পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্যেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা গণহত্যা
২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা আধুনিক যুগের জাতিগত নির্মূলের একটি স্পষ্ট উদাহরণ। রাখাইন রাজ্যের মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগণ বহুদিন ধরে মিয়ানমার সরকারের বৈষম্য এবং সহিংসতার শিকার ছিল। নাগরিকত্বের অভাব, পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত হওয়া, তাদের ২০১৭ সালের আগস্টে সহিংসতা শুরুর সময় নিপীড়নের জন্য সহজ লক্ষ্য বানিয়েছিল। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)-এর দ্বারা পুলিশ পোস্টে হামলার প্রতিক্রিয়ায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে এক নিষ্ঠুর দমন অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর ফলে, ৭৩,০০০-এরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ এই সহিংসতাকে ‘জাতিগত নির্মূলের একটি পাঠ্যবই উদাহরণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। অসংখ্য মানবাধিকার সংস্থা এই গণহত্যার তথ্য নথিভুক্ত করেছে, যেখানে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণের ব্যবহারের কথাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
গণহত্যার বিপুল প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছিল অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল। মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের  নৃশংস কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। জাতিসংঘ সহিংসতার নিন্দা জানালেও মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এই সহিংসতার তদন্ত শুরু করেছে। তবে চীন এবং রাশিয়ার মতো শক্তিধর দেশের সমর্থন এবং মিয়ানমারের প্রতি তাদের কৌশলগত আগ্রহ এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
রোহিঙ্গারা এখনও রাষ্ট্রহীন এবং বাস্তুচ্যুত অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম অব্যাহত থাকলেও ২০১৭ সালের গণহত্যার জন্য দায়ীদের জবাবদিহির অভাব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দুর্বলতা এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের অনীহাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। বর্তমানে, ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের ৩০টির বেশি শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। তারা নিজগৃহে ফিরে যাওয়ার কোনো বাস্তবসম্মত আশা ছাড়াই অসহনীয় দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

গাজা সংঘাত- একটি চলমান গণহত্যা
হলোকাস্ট গণহত্যার বিপরীতে গাজায় চলমান সংঘর্ষ মানব ইতিহাসের আরেকটি মর্মান্তিক অধ্যায়, যা জাতিগত নির্মূল এবং গণহত্যার একটি অংশ হয়ে উঠেছে। এটি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে এনেছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা দমন, বৈষম্য এবং সহিংসতার শিকার হয়ে আসছে। তবে গাজার পরিস্থিতি বিশেষভাবে নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। কারণ, ২০০৭ সাল থেকে এই অঞ্চলটি ইসরাইলের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। এর ফলে, গাজা কার্যত এক বিশাল খোলা কারাগারে পরিণত হয়েছে, যেখানে বাসিন্দারা মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত। যে ইহুদিদের নিধনের স্মরণে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়, সেই ইহুদিরাই গাজায় চালিয়েছে নৃশংসতম গণহত্যা। এই হত্যাযজ্ঞে ইসরাইলের জন্য একটি প্রধান সহায়ক শক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে প্রভাবশালী এবং সমৃদ্ধ দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহায়তা ছাড়া ইসরাইলের পক্ষে এমন নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা সম্ভব হতো না।
গাজা উপত্যকায় প্রায় দুই মিলিয়ন ফিলিস্তিনি বসবাস করেন, যাদের ওপর ইসরাইল বারবার সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে। এসব অভিযানের ফলে অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ২০২৩ সালে এই সহিংসতা একটি ভয়াবহ মাত্রা অর্জন করে, যখন ইসরাইল হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এই ধ্বংসযজ্ঞে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৭,০০০ গাজাবাসী নিহত হয়েছেন, যাদের ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। নিহতদের মধ্যে ৫-৯ বছর বয়সী শিশুদের সংখ্যা প্রায় ৪৫ শতাংশ।
মানুষের পাশাপাশি গাজার স্কুল, মসজিদ এবং ৩০টির বেশি হাসপাতাল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের অফিস, আশ্রয়কেন্দ্র এবং কর্মীরাও এই সহিংসতার শিকার হয়েছে। নিহতদের মধ্যে জাতিসংঘের স্টাফ এবং মিডিয়াকর্মীরাও রয়েছেন। এই নৃশংস অভিযানে প্রায় ১৭০ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। আহতের সংখ্যা এক লক্ষাধিক, যারা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে অমানবিক অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। ইসরাইলের অবরোধের পাশাপাশি এই সামরিক হামলার সমন্বয়ে গাজার পরিস্থিতি এক ভয়াবহ গণহত্যায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ অবরোধের ফলে জনগণ মৌলিক খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এভাবে মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা এবং নীরবতার একটি নির্মম চিত্র তুলে ধরছে।
১৫ মাস পর, ১৯ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সঙ্গে গাজার যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও এতে ইসরাইলের আন্তরিকতার ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে। চুক্তির সম্মতি সত্ত্বেও কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত মুহূর্ত পর্যন্ত গাজার ওপর ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমণ অব্যাহত ছিল এবং বহু গাজাবাসী নিহত হয়েছে। আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে পুনরায় আক্রমণ। ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জারি করা নির্বাহী আদেশ বাতিল করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দায়িত্ব গ্রহণের দিনই (২০ জানুয়ারি)। এই সিদ্ধান্তের পর বসতি স্থাপনকারীরা ইসরাইলি সেনাদের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে এবং বহু ফিলিস্তিনি নিষ্ঠুরভাবে আহত হয়েছেন, কয়েকজন নিহত হয়েছে।
যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহিংসতার নিন্দা করেছে, তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিশালী দেশগুলো কৌশলগত আগ্রহ এবং ভূরাজনৈতিক জোটের কারণে ইসরাইলের পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে, গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণ সম্মিলিত শাস্তি পাচ্ছে এবং ইসরাইলের কর্মকাণ্ডে দায়ী না হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করেছে। তবে বলা যায় না যে, এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে।

বৈশ্বিক জবাবদিহির তাগিদ
হলোকাস্টের শিকারদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস শুধু অতীত স্মরণ করার জন্য নয়; এটি একটি ঐতিহাসিক তাগিদ। হলোকাস্ট একটি শক্তিশালী স্মরণিকা হিসেবে কাজ করে যে, যখন বিশ্ব একটি জনগণের সিস্টেম্যাটিক ধ্বংসের মুখোমুখি হয় এবং তা উপেক্ষা করা হয়, তখন কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। তবে, যখন আমরা হোলোকাস্টে নিহত ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে স্মরণ করি, তখন আমাদের ১৯৭১ সালে বাঙালিদের, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের মতো অন্যান্য গণহত্যার অসহায় শিকারদেরও স্মরণ করতে হবে। এই পাশবিকতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের প্রতি কোনো জবাবদিহির অভাব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ এবং অন্য বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু নিন্দা জানানো ছাড়াও আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভবিষ্যতে এমন গণহত্যা রোধ করতে এবং অতীতের অপরাধীদের জবাবদিহি করতে তাদের যথাযথভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভূরাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। একটি বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা নিশ্চিত করবে যে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
যতটুকু আমরা হলোকাস্টের শিকারদের স্মরণ করি, তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি এখনো যারা দুঃখ ভোগ করছেন, তাদের জন্যও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানোর দায় বিশ্ববাসীর। মানবাধিকার ও মর্যাদার জন্য সংগ্রাম একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা হতে হবে এবং এটি কখনো ভুলে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে, যাতে কখনোই এমন পাশবিকতার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
    লেখক:  অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×