সুন্নি অধ্যুষিত সৌদি আরব এবং শিয়া অধ্যুষিত ইরান দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দুই পরস্পরবিরোধী শক্তি। কয়েক দশক ধরে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করছে। রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে দেশ দুটির ভাবনা ভিন্ন। তা থেকেই মূলত দেশ দুটির পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের যাত্রা শুরু। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইসলাম নিয়ে ইরান সরকারের বোঝাপড়া ছিল সামাজিক বিপ্লবের জায়গা থেকে। আর সৌদি আরব নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্মের ওপর নির্ভর করতে থাকে। ২০১০ সালের আরব বসন্তের সময় দেশ দুটি ভিন্ন মেরুতে অবস্থান নেয়। গাঠনিক রূপ দিয়ে ইরান এই আন্দোলনকে ব্যবহার করতে পারে- সৌদি রাজ পরিবারের এমন আশঙ্কা ছিল। একজন প্রখ্যাত শিয়া ধর্মগুরুকে ২০১৬ সালে সৌদি আরব মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এর জের ধরেই ইরান দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এদিকে ইয়েমেনে সৌদি সমর্থিত সরকারকে উচ্ছেদ করায় ইরান সমর্থিত হুতি সেনাদের সঙ্গে ২০১৫ সাল থেকে সৌদি নেতৃত্বাধীন একটি জোট যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে বহুবার পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে অংশ নেয় সৌদি আরব ও ইরান। গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার মাঝে ২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করে দেশ দুটি। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশ দুটির মধ্যে চুক্তি সম্পাদনেও চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চীন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা নিতে চাইছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিষয়টি অনেক বেশি স্পষ্ট হয়েছে। নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি, দুই মাসের মধ্যে নিজ নিজ দেশে দূতাবাস পুনরায় চালু এবং বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান পুনরুজ্জীবিত করার মধ্য দিয়ে সাত বছরের বৈরী সম্পর্ক থেকে সৌদি আরব ও ইরান বের হয়ে এসেছে। এতে বিস্মিত হয়েছেন বিশ্বনেতারা। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রসহ তার পশ্চিমা মিত্র এবং ইসরাইল এমন পদেক্ষেপের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের আকাক্সক্ষা সাম্প্রতিক সৌদি আরব-ইরান ইস্যুতে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিল অব ইউনাইটেড স্টেটসের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ ফেলো জোনাথন ফুলটন বলেন, চীন মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা চায়। কারণ, উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে নিজেদের চাহিদার ৪০ শতাংশের বেশি জ¦ালানি আমদানি করে চীন। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা চলমান থাকলে, তা চীনের স্বার্থের জন্য হুমকিস্বরূপ। ইসরাইলের বিরোধী দলের নেতা ইয়ার লাপিদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক চুক্তি ইসরাইল সরকারের ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতির ফল।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন একটি নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। চীনের জন্য এ কূটনৈতিক সাফল্য একটি গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করছে; যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে পশ্চিমা বিশে^র প্রভাবকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান গত কয়েক বছরে কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। তাঁর ভিশন ২০৩০ সৌদি আরবের তেলনির্ভর অর্থনীতি ঢেলে সাজিয়ে পর্যটনশিল্প ও বিদেশি বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন। ভিশন ২০৩০ সফল করতে আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের শত্রুতা অবসানের চেষ্টা করছে সৌদি আরব। ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ওই পরিকল্পনারই অংশ। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রভাবও খর্ব করতে চাইছে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্র এখনো সৌদি আরবের সামরিক অস্ত্রের বৃহত্তম জোগানদার হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্যোগ গ্রহণ করে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হোক; যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল শুধু নয়, অধিকাংশ পশ্চিমা দেশও তা চায় না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্কের ফাটল ধরিয়ে রেখেছে। এতে করে ইসরাইল যেমন নিজেদের নিরাপদ ভাবে, তেমনই অস্ত্র ও বিপুল সামরিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সাধারণত একই ধরনের পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। তাছাড়াও চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বৈরী সম্পর্ক থাকলেও কূটনেতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চীন পারদর্শিতা দেখিয়েছে। ইরান ও সৌদি আরব সম্পর্কে উষ্ণতা ফিরে এলে চীন সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে পুনরায় শান্তি স্থাপনে চীন রাশিয়ার কৌশলই অবলম্বন করেছে। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ইতিবাচক ভূমিকাকে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র হুমকি হিসেবে দেখছে।
সম্প্রতি ইরানের ওপর ইসরাইলের হামলাকে দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মের লঙ্ঘন উল্লেখ করে সৌদি আরব ২৬ অক্টোবর নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, এই অঞ্চলে ক্রমাগত উত্তেজনা এবং জনগণের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপÑ এমন সংঘাতের বিস্তার প্রত্যাখান করে দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করছে সৌদি আরব। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলে অব্যাহত সামরিক সংঘাতের প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে ‘সর্বোচ্চ সংযম অনুশীলন এবং উত্তেজনা হ্রাস করার’ জন্য সকল পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে সৌদি আরব। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়েই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই হামলা চালাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের চলমান আগ্রাসন ও উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ওমান সাগরে সৌদি আরব ও ইরান যৌথ মহড়া চালিয়েছে। ২৩ অক্টোবর টাইমস অব ইসরাইল জানায়, সৌদি আরব ও ইরান সম্প্রতি ওমান সাগরে সফল একটি যৌথ নৌমহড়ায় অংশগ্রহণ করে। সৌদি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তুর্কি আল-মালকি বলেন, রাজকীয় সৌদি নৌবাহিনী সম্প্রতি ওমান সাগরে ইরান ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে একটি যৌথ নৌমহড়া সমাপ্ত করেছে। ইরানের নৌবাহিনীর কমান্ডার অ্যাডমিরাল শাহরাম ইরানি জানিয়েছেন, সামনে লোহিত সাগরে যৌথ মহড়া আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে সৌদি আরব। তিনি আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে সমন্বয় চলছে। দীর্ঘদিনের শত্রুতা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন থাকার পর, এ দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে ঐক্য গড়ে উঠেছে। এই ঐক্য মধ্যপ্রাচ্যকে একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করছে। মধ্যপ্রাচ্যের এমন পরিস্থিতিতে এমন মহড়া দুই দেশের সামরিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে এমন ঐক্য ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই প্রধান শক্তির মধ্যে গড়ে ওঠা এমন নতুন ঐক্য সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনে দুই দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলমান থাকা সত্ত্বেও ইয়েমেন প্রশ্নে দেশ দুটি দুই মেরুতে অবস্থান করছে। ইরান সমর্থিত হুতি মিলিশিয়ারা ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবেদ রাবু মানসুরকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছে এবং দেশটির কিছু অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সুন্নি দেশগুলোর যে জোট তা যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্র দেশগুলোর সমর্থন পাচ্ছে। তারা হুতিদের মোকাবিলা করে এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ঠেকাতে তৎপর। এমনিতেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইসরাইল শঙ্কায় থাকে। তার ওপর সৌদি আরবের পারমাণবিক শক্তি ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তাই ইসরাইল চাইবে না মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পারমাণবিক শক্তির উত্থান ঘটুক। ইসরাইল ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য সৌদি আরব সফর করছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বৈঠকে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আঞ্চলিক ইস্যু এবং গাজা ও লেবাননে হামলা বন্ধে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছেন আরাকচি। আরাকচি বলেছেন, এই অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা ও সংলাপ অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে গাজা যুদ্ধ চালানোর পাশাপাশি ইসরাইল লেবাননেও যে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তা বন্ধের বিষয়েও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গেও ইরানের একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরাকচি বলেন, আমাদের সম্পর্ক সবসময় উত্থান-পতনের মধ্যে ছিল। কিন্তু এই সম্পর্কগুলো আঞ্চলিক সহযোগিতায় পরিণত হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। এদিকে প্রতিরক্ষা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ইরান সফর করেছেন সৌদি সেনাপ্রধান ফায়াদ আল-রুয়ালি। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের সেনাপ্রধান মোহাম্মদ বাঘেরির সঙ্গে বৈঠক করেছেন সৌদি সেনাপ্রধান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের এ বৈঠক হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের আঞ্চলিক শত্রু ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ প্রচেষ্টা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত। যদিও এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে কাক্সিক্ষত শান্তি আনতে পারেনি। যেসকল আরব রাষ্ট্র এই অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করেছিল তাদের কেউই বিগত কয়েক দশকে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে এই চুক্তিতে ইরান এবং সিরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ এই দুটি দেশের সঙ্গেই ইসরাইলের সক্রিয় বিরোধ বিদ্যমান। এই অ্যাকর্ডের আওতায় মরক্কো, সুদান, আরব আমিরাত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও সৌদি আরব এখনো ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেনি।
সৌদি আরবের অন্যতম নিরাপত্তাঝুঁকি হচ্ছে ইরান। ইরানের সঙ্গে সমঝোতা হলে এবং অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে চীন নিশ্চয়তা দিলে সৌদি আরবের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে। প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা করেছে, যা আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করেছে। তবে দুই দেশের সম্পর্ক এখনো কঠিনই রয়েছে। সম্প্রতি গাজায় গণহত্যা ও লেবাননে ইসরাইলের চলমান অভিযানের মাঝে আবার সম্পর্ক জোরদার করে সৌদি আরবও ইরান। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও বৃদ্ধি পেলে এই দুই দেশ জোটবদ্ধ হতে পারে। এই পরিবর্তনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণে নতুন করে দিকনির্দেশনা আসতে পারে। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার এই ঐক্য মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ইরান-চীন-সৌদি আরব ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে আরও জটিল করে তুলবে এবং আরবদের সুবিধা দেবে। জার্মানির থিংক ট্যাংক সিএআরপিও-এর বিশ্লেষক সেবাস্টিয়ান সোনস বলেন, ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনায় ইরানের হামলার পর সৌদি আরব উপলব্ধি করেছে, তারা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে পারবে না। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ইরানের সঙ্গে বৈরিতারও অবসান করতে হবে। সৌদি আরব বুঝতে পেরেছে যে, তেলের ওপর নির্ভর করা রিয়াদের নিকট দেশটির অর্থনীতির সফলতা নির্ভর করবে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর। তাছাড়া সৌদি আরবে মিসাইল হামলার ঘটনাও বন্ধ করতে চায় দেশটি।
সৌদি আরবের ধারণা, হুতি মিলিশিয়াদের ইরান প্রভাবিত করতে পারে। জার্মানির বার্লিনের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের হামিদ রেজা আজিজি সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ইরানের স্বার্থ প্রসঙ্গে বলেন, বছরের পর বছর ধরে ইরোনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা, দেশের তেল সম্পদের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি ইরানকে সমূহ ক্ষতির মুখে পতিত করেছে। অর্থনৈতিক এই অস্থিরতার কারণে দেশের ভেতরে আন্দোলন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করে ইরান। পশ্চিমাদের সঙ্গে যেহেতু পরমাণু বিষয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও ওঠাতে পারেনি; তাই এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ইরান বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা যেমনÑ ব্রিকস, সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হতে ইচ্ছুক। একইসঙ্গে প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। নিরাপত্তার ব্যাপারে ইরানের উদ্বেগ রয়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের আগে সৌদি আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা আর প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, সৌদি আরব এরই মধ্যে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে দুই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা সামনে নিয়ে এসেছে; যা ইসরাইলের কূটনৈতিক মনোভাবের বিরোধী। তবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ কিংবা ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার ইচ্ছেও সৌদি আরবের নেই। সৌদি আরব এক ধরনের কৌশলগত অবস্থান নিতে চায়। সকল পক্ষের মধ্যস্থতাকারী হওয়ার মতো একটি অবস্থান নিতে চায় সৌদি আরব। কাতারও একই ভূমিকা পালন করছে। সোনস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সৌদি আরবের মাধ্যমে ইরানকে বার্তা পাঠানো হয়েছে। সৌদি আরবের এ ধরনের কৌশলগত অবস্থান আঞ্চলিক নীতি এবং কূটনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আজিজিও মনে করেন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার সুসম্পর্ক এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা তৈরি করবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়, তাহলে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও তা হবে মঙ্গলজনক।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদি আরব-ইরান সম্পর্কের প্রভাব
শীর্ষ সংবাদ: