আত্মহত্যা সমাজে এক মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে কাজ করছে। প্রতিদিন বা সপ্তাহে কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে। ইদানীং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই আত্মহত্যা করে থাকে। সম্প্রতি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া এলাকায় নিজ বাড়িতে প্রেমিকের সঙ্গে অভিমান করে এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ২০২২ সালে সারাদেশে এক বছরে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে জানতে পারি। যার মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে সে বছর। ২০২৩ সালে দেশে মোট ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যাদের ৬০ শতাংশই নারী। এর মধ্যে ৬৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থীর হার বেশি। ২০২৪ সালে সারা দেশে ৩১০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৪৬.১ শতাংশই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী। আর সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে মেয়ে শিক্ষার্থী, যা শতাংশে ৬১ ।
আত্মহননে দেশ-জাতি হারিয়েছে অনেক মেধাবী ও তরুণ শিক্ষার্থীকে। অভিভাবক হারিয়েছেন তার প্রিয় মেধাবী সন্তানকে। এ ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। আত্মহত্যার পেছনে কারণ রয়েছে পারিবারিক সমস্যা, প্রেমের সম্পর্কজনিত দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা, অবসাদ, আর্থিক সংকট, কিছু পাওয়ার জেদ, না পাওয়ার হতাশা, পড়াশোনার চাপ, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, মানসিক নির্যাতন, চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা শুনতে হয়। এ জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অনেক সময় প্রকৃত উদ্দেশ্য বের করা হয়, আবার কখনো হয় না। এ রকম ঘটনা প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে। আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করে এক শিক্ষার্থী। এসব ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। সে তাদের ব্যাচের প্রথম সারির ছাত্রী ছিল। এ ছাড়াও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের এক ছাত্রী অনুষদ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (২০০৫-২০২০) এই সময়ে আত্মহত্যা করেছে ২৩ বা এর বেশি ছাত্রছাত্রী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (২০১০-২০২০) বছরে ১১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। তাদের মধ্যে ছয়জন মেয়ে ও পাঁচজন ছেলে। দেশের এ মেধাবী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ কী, তা নিয়ে রয়েছে নানা ব্যাখ্যা ও মতামত। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো প্রতিকারেরব্যবস্থা নিয়েছে কিনা জানি না। তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপের ফল অনুসারে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৪ জুন পর্যন্ত দেশে ১৫১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ৭৩ স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ সংখ্যা ২০১৮ সালে ১১ ও ২০১৭ সালে ১৯ ছিল। নানা কারণে চাপে থাকা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দপ্তর রয়েছে। ‘ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শ দপ্তর’ নামের এই দপ্তরে একজন শিক্ষক কাউন্সিলর বা পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে থাকেন। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী নেই বললে চলে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুসারে প্রতিটি বিভাগে একজন করে মনোবিজ্ঞানী থাকা উচিত। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য একজন ছাত্র উপদেষ্টা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। আবার যেসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেÑ এর পেছনের কারণ কী, তা উদ্ঘাটন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। পরামর্শ দপ্তরও এ বিষয়ে কোনো তথ্য সংরক্ষণ করে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার পরামর্শ দপ্তর সম্পর্কে অনেক শিক্ষার্থীর ধারণা নেই যে, এ দপ্তর তাদের জন্য কী করতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও উদ্যোগের অভাব রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শ দপ্তরে স্থায়ী পরামর্শকের পদ আরও বৃদ্ধি করা উচিত বলে মনে করেন অনেক শিক্ষক। প্রতিটি বিভাগে একজন সহকারী ছাত্র উপদেষ্টা দরকার এবং প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া একান্ত জরুরি। তা হলে আত্মহত্যা কিছুটা হলেও কমানো যাবে।
আত্মহত্যা বন্ধে অভিভাবকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। ছেলেমেয়ে রাগ করলে তাকে নজরে রাখতে হবে এবং দ্রুত সময়ে তাকে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের কাছে যেতে লজ্জা পান। তবে শিক্ষার্থীদের উচিত হবে, যে কোনো সমস্যা হলে শিক্ষকের শরণাপন্ন হওয়া। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাদের অভিভাবক। অবশ্য অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষাভীতি, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা, মানসিক চাপÑ এসব সমস্যা নিয়ে মাঝে মধ্যে শিক্ষকদের কাছে আসেন। শিক্ষকদেরও দায়িত্ব রয়েছে, তারা যেন পাঠদান কক্ষে এবং অন্যান্য সময়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য ও জীবন নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক দিকনির্দেশনা দেনÑ যা তাদের হতাশা কমাতে সহযোগিতা করে। আত্মহনন প্রতিরোধে প্রধান কাজ হলো ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীভিত্তিক মানসিক পরামর্শ, শিক্ষার্থীদের যে কোনো সংকটে সহযোগিতা এবং সমস্যা নিয়ে পরামর্শ, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও প্রচার, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা পর্যালোচনা, স্বেচ্ছাসেবক তৈরি এবং অনুষদ বা বিভাগভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। বিশেষ আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের সহায়তার বিষয়ে জোর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কোনো আত্মহত্যাই সমাজ বা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, বরং দুঃখজনক। প্রতিকারের ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরামর্শ ও সেবা দেওয়ার গুরুত্ব অনেক। আত্মহত্যা বন্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ জরুরি। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ট্যান্ডার্ড নীতিমালা ও দক্ষ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে দ্রুত মানসিক সেবা চালু করা একান্ত প্রয়োজন। ১৯৯০ সালের শুরুতে প্রথম গ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক ও ব্যক্তিগতÑ আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় হিসেবে শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শের প্রয়োজনীয়তার জন্য সচেতনতার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম ছাত্র কাউন্সেলিং সেন্টার ১৯৯০ সালে এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আনাস্তাসিয়া কালান্টজি আজিজি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে। দিন দিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে। তাই ছাত্র পরামর্শ দপ্তরের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শের জন্য আলাদা অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বা কর্মী দিয়ে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইকোলজি কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও সাইকোলজিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটা কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। পর্যাপ্ত কাউন্সেলিংয়ের সুযোগ না থাকায় শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার মতো ভয়ানক পন্থা অবলম্বন করে থাকে বলে অনেকে মনে করেন। মানসিক সমস্যা ও বিষণ্নতায় ভুগতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষাবিদ। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত মনোবিদ ও মনোচিকিৎসক নেই। দেশে প্রায় ৩০০ মনোচিকিৎসক ও ৪০০-৫০০ জনের মতো মনোবিদ রয়েছেন। সরকার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মানসিক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থীদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায়, সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আর যারা পড়াশোনা শেষ করে বেকারত্বে ভুগছেন, তাদের জন্য চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করা আবশ্যক। একই সঙ্গে তাদের প্রণোদনা দিতে হবেÑ যাতে তারা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হন। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঝুঁকিতে পড়বে এবং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা মনে করিÑ এই সমস্যার সমাধানে বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে একটি সম্মিলিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। যার আলোকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মহনন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ