ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১

ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি

রাজিব ভাটিয়া

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি

ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি (এইপি) দেশের পররাষ্ট্র নীতির কাঠামোতে উচ্চ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। এই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা ও সম্পদ বরাদ্দ করার মধ্য দিয়ে এবং অঞ্চলটির রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক সম্মুখীন হওয়া মানবিক সহায়তা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য সংক্রান্ত নানাবিধ বিষয় সমাধানের ক্ষেত্রে এটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। ভারতের নেতৃবৃন্দ ও কূটনীতিকগণ দ্বিপাক্ষিক, উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক স্তরে সমস্ত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয় ও গঠনমূলকভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। ভারত পূর্বাঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ক্রীড়নক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসান বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজতে শুরু করার ক্ষেত্রে ভারতের জন্য একটি নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে যখন দেশটি বড় আকারে অর্থনৈতিক উদারীকরণে প্রবৃত্ত হয়। এভাবেই ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে লুক ইস্ট পলিসির সূচনা হয়। এই পটভূমিতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৩ নভেম্বর ২০১৪-এ মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত ৯ম পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের অধিবেশনে মঞ্চে উঠে ঘোষণা করেন, ‘ছয় মাস আগে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, আমার সরকার অগ্রাধিকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি নিয়ে এগিয়ে চলেছে এবং আমাদের লুক ইস্ট পলিসিকে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসিতে রূপান্তরিত করতে সম্মত হয়েছে।’
পুরনো নীতি থেকে নতুন নীতিতে পরিবর্তন শুধু নাম পরিবর্তন ছিল না। এটি ছিল একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশে দেশের বিস্তীর্ণ স্বার্থসমূহের অন্বেষণ করার জন্য ভারতের বাড়তি সংকল্পকে প্রতিফলিত করে, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পুনর্বিন্যাস। নীতির লক্ষ্য এখন শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, বরং পুরো পূর্ব এশিয়া, যদিও সেটা আসিয়ান-এর ‘কেন্দ্রিকতা’-এর প্রতি কোনো আপোস ছাড়াই। তদুপরি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত হিসাব-নিকাশ পূর্ববর্তী মূলত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার প্যাকেজের সঙ্গে যোগ করা হয়েছিল। একটি নতুন নীতিগত লক্ষ্য ছিল ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের দিকে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেওয়া। অবশেষে, যখন চীনের আগ্রাসন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন ভারতের প্রতিশ্রুতিসমূহ বাস্তবায়নে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া ছিল নতুন নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
একই দশকের শেষের দিকে, এইপি-র ওপর ভিত্তি করে ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন গড়ে উঠেছিল, যেখানে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে গভীর আন্তঃসংযুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এটি সাগার (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিওন- অঞ্চলের সবার জন্য নিরাপত্তা ও উন্নতি) মতবাদের দ্বারা আরও শক্তিশালী হয়েছিল। ধারাবাহিকভাবে, ভারত একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে সমর্থন করে, যা একটি নীতিভিত্তিক আন্তর্জাতিক আদর্শের ওপর নির্মিত, যেমনটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ২০২২ সালের আগস্টে থাইল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় জোর দিয়ে বলেছিলেন।
বিগত দশকে (২০১৪-২০২৪) এইপির প্রভাব বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। প্রথমত, আসিয়ানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শক্তিশালী থেকে আরও শক্তিশালী হয়েছে। বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন একটি মূল্যবান সুযোগ প্রদান করে, যা প্রগতির পর্যালোচনা করতে এবং রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ও সাংস্কৃতিক, শিক্ষাবিষয়ক ও মানুষে-মানুষে বন্ধনের ক্ষেত্রে আরও কিছু কাজ করার ব্যাপারে সহায়ক। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০১৪-১৫ সালে ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২৩-২৪ সালে ১২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে ভারত থেকে আসিয়ান-এ বার্ষিক এফডিআই প্রবাহ ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৫.৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যেখানে ২০০০-২৪ সাল পর্যন্ত ভারতের মধ্যে আসিয়ান-এর মোট বিনিয়োগ ১১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে মূল্যায়িত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, ভারত ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ১৪তম পূর্ব এশিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে ইন্দো-প্যাসিফিক ওশান্স ইনিশিয়েটিভস (আইপিওআই) চালু করেছে। এটি সাতটি স্তম্ভে কেন্দ্রিত, যেমনÑ সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সামুদ্রিক পরিবেশ ও সামুদ্রিক সম্পদ এবং এটি আসিয়ান আউটলুক অন ইন্দো-প্যাসিফিক (এওআইপি)-এর জন্য একটি প্রাকৃতিক সঙ্গতি। দুটি উদ্যোগের মধ্যে সহযোগিতামূলক প্রকল্পসমূহ আলোচনাধীন রয়েছে ও ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, আসিয়ানের সীমানা অতিক্রম করে এবং একটি বিস্তৃত কৌশলগত পদ্ধতি গ্রহণ করে ভারত কোয়াড নামে পরিচিত চার-শক্তির একটি গোষ্ঠী গঠন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেতা হয়ে উঠেছে। এর অন্য সদস্যরা হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। সম্প্রতি, এই গোষ্ঠী তার ২০তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ উল্লেখ করেছেন, ‘একটি বিপর্যয়ের জরুরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে যেটা শুরু হয়েছিল, সেটা আমাদের অঞ্চলের মানুষের জন্য ইতিবাচক ফল প্রদানকারী একটি পূর্ণাঙ্গ অংশীদারিত্বে রূপ নিয়েছে।’ চতুর্থত, এইপি ভারতকে ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ), বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টোরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) ও প্যাসিফিক আইল্যান্ডস ফোরাম (পিআইএফ)-এর মতো অন্য আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করার জন্য উৎসাহিত করেছে। এই সংস্থাগুলোর ক্রমাগত শক্তিশালীকরণ ও তাদের বহুমুখী কার্যক্রমে ভারতের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা নীতিটির সাফল্যের প্রমাণ। তবে এই ক্ষেত্রে আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজন।
মিয়ানমারের গভীর সংকট ভারতের বৃহৎ সংযোগ প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে, যেমনÑ ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক ও কালাদান বহুমুখী পরিবহন প্রকল্প। আসিয়ান ও মিয়ানমারের প্রতিবেশীদের উচিত, মিয়ানমারের বিভিন্ন অংশীজনকে সহিংস সংঘাত থেকে সরিয়ে এনে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ফিরে আসার জন্য তাদের প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করা। বিস্তৃত এই অঞ্চলের চ্যালেঞ্জসমূহের প্রতি মনোযোগী থাকলেও, ভারতের কূটনীতিকে প্রধান অংশীদারদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর করার দিকে মনোযোগী থাকতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে, প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপনে প্রধান অতিথি হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তোর ভারত সফর ভবিষ্যতের জন্য শুভ সংকেত বহন করে।

লেখক : গেটওয়ে হাউসের ডিস্টিংগুইশড ফেলো, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত

×