..
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদ-নদী যেন জালের মতো বিছিয়ে আছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে এক হাজারের ওপরে নদী রয়েছে অর্থাৎ প্রকৃত সংখ্যা ১০০৮টি। কিন্তু এসব নদ-নদীর মধ্যে আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো একটি ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের নদীকে ঘিরে; যা হলো হালদা নদী। বস্তুত হালদা নদী বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। আর ১০০৮টির মধ্যে পাহাড়ি অঞ্চলের নদীর আওতায় ১৬নং নদী হিসেবে চিহ্নিত বা পরিচিত হালদা। এদিকে হালদা নদীর উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে নেমে আসা হালদা নদী, যা সালদার অপভ্রংশপূর্বক হালদা নামকরণ হয়েছে বলে জানা যায়। নদীটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাটনাতলী পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে এটি ফটিকছড়ির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় প্রবেশ করেছে। তৎপর দক্ষিণ-পশ্চিমে ও পরে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ফটিকছড়ির বিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট, হাটহাজারী, রাউজান এবং চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও-বাকলিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিতপূর্বক কালুরঘাটের নিকটে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এর ২৯ কিলোমিটার অংশ সারাবছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। মজার বিষয় হলো যে, এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে এবং সেখান থেকে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে একটি কথা হলো যে, হালদার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য নদী যেমন : পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর সংযোগ না থাকাতে রুই জাতীয় মাছের ‘জিনগত মজুদ’ সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এতদ্ব্যতীত কেবল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের ক্ষেত্রে হালদার ঐতিহ্য নয়। এটি ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যেরও পুরোপুরি যোগ্যতা রাখে।
পূর্বেই কিছুটা বলেছি যে, এই নদীর বৈশিষ্ট্য অন্য যে কোনো নদীর চেয়ে আলাদা। প্রথমত : হালদা একান্তই আমাদের নিজস্ব নদী। এর উৎপত্তি, বিস্তার এবং সমাপ্তি সবই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। দ্বিতীয়ত, হালদা নদী এখন আন্তর্জাতিকভাবে একটি জনপ্রিয় নদীতে রূপ নিয়েছে। কেননা, এটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে রুইজাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ) নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, পৃথিবীর আর কোনো জোয়ার-ভাটার নদী থেকে এমন রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা যায় না। এদিকে বাংলাদেশে মৎস্য প্রজননক্ষেত্র অনেক আছে। কিন্তু মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয় এমন নদী একটিও নেই। মূলত হালদা নদীতে মাছের প্রজননের সময় হচ্ছে তিন মাস (যেমন-এপ্রিল, মে এবং জুন)। এই তিন মাসে ছয়টি ‘জো’ এর আওতায় অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে এখানে রুইজাতীয় মাছ নিষিক্ত ডিম ছাড়ে। আর যে ভাবেই বলি না কেন, হালদা নদী বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক জিনব্যাংক হিসেবে অভিহিত এবং সুপরিচিত।
নানা সমস্যা সত্ত্বেও এই প্রাকৃতিক জিনব্যাংক বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে হালদা নদীর গুরুত্ব খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কেননা, বলতে গেলে অন্যান্য উৎস এবং কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রগুলোতে অপরিকল্পিত প্রজনন ও ইনব্রিডিংয়ের কারণে মাছের বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বামনত্ব ও বিকলাঙ্গতাসহ বিভিন্ন ধরনের জিনগত সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। কোনো কারণে যদি হালদা নদীর মাছ ক্ষতিগ্রস্ত বা অন্য মাছের সঙ্গে ক্রস হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী থেকে অরিজিনাল রুইজাতীয় মাছের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। তাই রুইজাতীয় মাছের প্রকৃত বংশধরদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। প্রকাশ থাকে যে, হালদা নদীকে চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইনও’ বলা হয়। কেননা, চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ বসবাস করে। তাদের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে পানি সরবরাহ করে, তার মধ্যে প্রতিদিন ১৮ কোটি লিটার পানি এই হালদা নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম শহরের একদিকে বঙ্গোপসাগর ও পাহাড় এবং অন্যদিকে মারাত্মক দূষণের শিকার কর্ণফুলী নদী। তাই চট্টগ্রামের একমাত্র ফ্রেশ ওয়াটার সোর্স হচ্ছে এই হালদা নদী। এক্ষেত্রে স্বভাবতই একটি কথা উঠে আসে যে, কোনো কারণে যদি হালদা নদী বিপন্ন হয়, তাহলে চট্টগ্রমের মানুষের জীবনযাত্রাই বিপন্ন হয়ে পড়বে।
আসলে হালদা নদীর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ অবদান অনেক। কারণ এ নদী থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়, তা থেকে উৎপাদিত রেণু, রেণু থেকে ধানি, ধানি থেকে আঙ্গুলি এবং আঙ্গুলি থেকে খাবারের জন্য মাছ সংগ্রহ করা হয়। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদী বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার অবদান রাখে। তাছাড়া পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি যে, পানি এবং অন্যান্য সম্পদের মূল্য বিবেচনায় নিলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হালদার অবদান ২০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে যাবে, তাতে এতটুকু সন্দেহ নেই। কেননা, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় হালদা নদী পাইভোটাল রোল প্লে করে থাকে। এদিকে তথ্য মতে জানা যায় যে, পৃথিবীতে বর্তমানে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০টির মতো ফ্রেশ ওয়াটার ডলফিন বা গাঙ্গেয় ডলফিন বেঁচে আছে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, হালদা নদীতে এখনো ১৪৭টি গাঙ্গেয় ডলফিন বেঁচে আছে, যা কম কথা নয়। এদিকে দেশে আগে অন্যান্য নদীতেও এই ডলফিন পাওয়া যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, অনেক নদী থেকেই ডলফিন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বলতে গেলে বর্তমানে একমাত্র হালদা নদীতেই এই ডলফিনের আশ্রয়স্থল। এতে প্রতীয়মান হয় যে, হালদা নদী কতটা গুরুত্ব নিয়ে উচ্চ মাত্রায় আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না।
হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছের ডিম ছাড়ার নেপথ্যে যে নিয়ামকগুলো নিহিত, তা বিশ্লেষণ করা আবশ্যক বলে মনে করি। এ বিষয়ে উল্লেখ্য যে, হালদা নদী এবং নদীর পানির কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে, যা বাংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে ভিন্নতর। এই বৈশিষ্ট্যগুলো (i) ভৌতিক, (ii) রাসায়নিক ও (iii) জৈবিক। (i) ভৌতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নদীর বাঁক, অনেক নিপাতিত পাহাড়ি ঝর্ণা বা ছড়া প্রতিটি পতিত ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, নদীর গভীরতা, কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোতা এবং অতি ঘোলাত্ব। (ii) রাসায়নিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কম কন্ডাক্টিভিটি, সহনশীল দ্রবীভূত অক্সিজেন, ইত্যাদি এবং (iii) জৈবিক কারণগুলো হচ্ছে বর্ষার সময় প্রথম বর্ষণের পর বিল থাকার কারণে এবং দুকুলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদীর পানিতে প্রচুর জৈব উপাদানের মিশ্রণের ফলে পর্যাপ্ত খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে, যা প্রজনন পূর্ব গোনাডের পরিপক্বতায় সাহায্য করে। অনেক পাহাড়ি ঝরনা বিধৌত পানিতে প্রচুর ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান থাকার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়, এই সব বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে হালদা নদীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে, যা বাংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে পৃথক। এদিকে হালদা নদীর বাঁকগুলোকে ‘অক্সবো’ বাঁক বলে। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পানির প্রচণ্ড ঘূর্ণন, যার ফলে গভীর খালের সৃষ্টি হয়। স্থানীয়ভাবে গভীর খাল বা স্থানগুলোকে ‘কুম’ বা ‘কুয়া’ বলা হয়। উজান হতে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ কুমের মধ্যে এসে জমা হয় বিধায় পানি অতি ঘোলা হয়, এতে মা মাছেরা কুমের মধ্যে আশ্রয় নেয় এবং যুগপৎ ডিম ছাড়তে স্বস্তি বোধ করে থাকে।
লেখক : বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ