ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১ মাঘ ১৪৩১

ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক প্রভাব

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক প্রভাব

.

২০ জানুয়ারি ২০২৫ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন। দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের অবগাহনে নানামুখী আলাপ-আলোচনা বেশ উচ্চকিত। শপথ গ্রহণের আগের দিন তিনি আমেরিকার পতন ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ ও অন্যান্য সংকট নিরসনে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় অতিশয় দৃশ্যমান। আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলার বিষয়ে তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ার অভিযোগে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই সরকারের চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছেন এবং এক হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে দিয়েছেন বহিষ্কারের হুমকি। ট্রাম্প সরকারের যাবতীয় নীতি নির্ধারণ বৈশ্বিক ভূরাজনীতিকে কোন্ পথে পরিচালিত করবে তা বিশেষ পর্যালোচনার দাবি রাখে। অভিষেক অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের দেওয়া বক্তব্য বৈশ্বিক অঙ্গনে বেশ সাড়া ফেলেছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পানিপথ পানামা খালের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তাঁর ভাষণে প্রতিফলিত। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা দেশের তালিকা থেকে কিউবার নাম বাদ দেওয়ার উদ্যোগ আটকে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নতুন মেয়াদ শুরুর দিনে তুলেছেন গ্রিনল্যান্ড কেনা ও কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রসঙ্গ। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ফোন করতে পারেন উভয় দেশের সরকার প্রধানদের। দুঃখজনক হলেও সত্য, অতিসম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া বহুল প্রতীক্ষিত গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আশাবাদী নন বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর এই মন্তব্যে বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষ বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিন নীতির পরিবর্তন চাওয়া বিশ্ববাসীকে প্রচণ্ড হতাশ করেছে।
বিশ্বজুড়ে মার্কিন নীতির প্রভাব সর্বজনস্বীকৃত। দেশটির ক্ষমতার পালাবদলে পররাষ্ট্রনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়েও নানা প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। প্রাসঙ্গিকতায় বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক অধ্যাপক স্টেফান উলফ বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির প্রথম দিকটি হতে পারে পশ্চিম গোলার্ধে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা। এই অঞ্চলের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বজায় রাখা। এ লক্ষ্যে তারা সম্ভবত হুমকিমূলক বক্তব্য, শুল্ক এবং রাজনৈতিক চাপ প্রদানের মতো পদক্ষেপ নিতে পারে। গ্রিনল্যান্ড, কানাডা ও পানামা খালের প্রসঙ্গ ইতোমধ্যে শিরোনামে স্থান পেয়েছে। আগামী দিনগুলোতে কিউবা, নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক নতুন কী চিত্র নির্মাণ করে, তাই দেখার বিষয়। দ্বিতীয় দিকটি হতে পারে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সম্পৃক্তা কমানো। ধারণা করা হচ্ছে, যেসব অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্তরের গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে, সেখানে নিজেদের সংযুক্তি কমানোর পরিকল্পনা করবে ট্রাম্প প্রশাসন। ইউক্রেন যুদ্ধের চুক্তির বিষয়টিও ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকবে। ন্যাটো মিত্রদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে ট্রাম্পের জোরালো দাবি ইঙ্গিত দেয় যে নতুন প্রশাসন ট্রান্সআটলান্টিক নিরাপত্তাকে বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখবে।’      
ইতোমধ্যে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ট্রাম্প প্রায় শতাধিক নির্বাহী আদেশ জারির পাশাপাশি পূর্বসূরি জো বাইডেন প্রশাসনের ৭৮টি আদেশ বাতিল করেছেন। এতে বিশ্বব্যবস্থায় কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ বিষয়েও পরিবর্তিত পরিবেশ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার ডালপালা বিশাল বিস্তৃত। মার্কিন জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে ট্রাম্প সরকারের কর্মকাণ্ড কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়েও প্রচুর গুঞ্জন রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বাক্ষর করা নির্বাহী আদেশের অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আদেশ। নির্বাচনি প্রচারে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভিবাসী বিতাড়ন কর্মসূচি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরই আলোকে নথিপত্রহীন অভিবাসীদের ধরপাকড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেড় হাজার সেনা, যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যাপক মাত্রায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে সন্দেহভাজনদের। এরই মধ্যে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস ইনফোর্সমেন্ট (আইস) কর্তৃক নিউইয়র্কের ব্রুকলিন বরোর ফুলটন এলাকা থেকে চার বাংলাদেশী গ্রেপ্তারের সংবাদ পরিবেশিত।
অন্যান্য আদেশের মধ্যে রয়েছে- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রত্যাহার, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে ফিরে আসা, আগামী ৯০ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সকল ধরনের বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচি স্থগিত, মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন, ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল, মেক্সিকান মাদক গ্যাংগুলোকে ‘বিদেশী সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা, আমাদানি পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্কারোপের প্রতিশ্রুতি, ক্রিপটোকারেন্সির মজুত, ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় অভিযুক্ত ১৬০০ সমর্থকের কারামুক্তি, ইউক্রেন যুদ্ধ, ডিইআই, টিকটক ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল (কেন্দ্রীয়) বাজেটের প্রায় ১ শতাংশই ব্যয় হয় বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচি তহবিলে। বাইডেন প্রশাসনের বৈদেশিক সহায়তা বিষয়ক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলে দুর্যোগত্রাণ, স্বাস্থ্য, গণতন্ত্রপন্থি উদ্যোগসহ বিভিন্ন খাতে মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচির জন্য ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী চুক্তির কারণে উক্ত সহায়তার প্রধান প্রাপক দেশ ইসরাইল পায় বার্ষিক ৩৩০ কোটি ডলার। অন্য দুটি দেশ মিসর ও জর্দান পায় যথাক্রমে বার্ষিক ১৫০ ও ১৭০ কোটি ডলার। তাছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধে কিয়েভকে বিশাল পারমাণের সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই ছিলেন এ বিদেশী সহায়তার সমালোচক। রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে ইউক্রেনকে রক্ষায় মার্কিন সহায়তার পরিমাণ নিয়েও তার উদ্বেগের বহির্প্রকাশ ঘটেছে। অনেকের ধারণা, চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সহায়তায় ট্রাম্প সরকারের কোনো প্রকার কার্টছাট করার সম্ভাবনা নেই।
মার্কিন অর্থনীতিতেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম অতি সুস্পষ্ট। তাঁর অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় রয়েছে বাণিজ্য সংস্কার, কর হ্রাস এবং সরকারি বিধিনিষেধ শিথিল করা। যদিও তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো মার্কিন অর্থনীতিকে কোন্ দিকে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির যেকোনো পরিবর্তন বিশ্ববাজারে একটি বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। তারা জানান, অর্থনীতিতে পরিষ্কার পরিকল্পনা না থাকলে মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করবে, যা অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিতে পারে। অনেকের আশঙ্কা, ট্রাম্পের নীতিগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে। এতে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হবে, যা সাধারণ মানুষের জন্য আরও চাপ সৃষ্টি করবে। আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের মতো পরিকল্পনা শেষমেশ সাধারণ ভোক্তাদের বাড়তি ব্যয়ের বোঝা চাপাবে। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ থেকে মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সংবাদে দরপতন হয়েছে দুই দেশের মুদ্রার। বেড়েছে ডলারের দাম এবং প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারেও। ব্লুমবার্গ ইকোনমিকসের মডেল অনুযায়ী, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শুল্ক আরোপের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়বে। এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক ক্ষতি পূরণে একে অপরের সঙ্গে আরও বেশি বাণিজ্য করবে। এতে বিশ্বায়ন চলমান থাকলেও সেটি আর যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রথমদিনে ট্রাম্পের জারি করা অনেক আদেশ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বিশেষ করে সংবিধানের বিরুদ্ধে যাওয়া অভিবাসন সংক্রান্ত আদেশগুলো আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। তবে বৈদেশিক সহায়তা বন্ধের আদেশ মার্কিন তহবিলের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, দেশটির অনেক কর্মসূচি এরই মধ্যে মার্কিন কংগ্রেসে তহবিল বরাদ্দ পেয়েছে। আর এসব অর্থ ইতোমধ্যে বিতরণ বা ব্যয় করা হয়েছে। গণমাধ্যম সূত্রমতে, অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ বাতিলকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপকে মার্কিন সংবিধানের ভয়ানক লঙ্ঘন দাবি করে ২১ জানুয়ারি বোস্টনের ফেডারেল আদালতে জোটবদ্ধভাবে মামলা করেছে ২২টি অঙ্গরাজ্য এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া ও সান ফ্রান্সিসকো শহর কর্তৃপক্ষ। এই আইনি লড়াইয়ে শরিক হয়েছে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার সংগঠনও। অভিবাসী ইস্যুতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশও। কারণ, বাংলাদেশের লক্ষাধিক মানুষ অভিবাসনপ্রত্যাশী। সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণে ধারণা করা যায় যে, ট্রাম্পের উত্থান শুধু আমেরিকায় নয়, পুরো বিশ্বব্যবস্থায় নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে এর সুরাহা কতটুকু কার্যকর হবে; ভবিষ্যৎই তা বলে দেবে। চলমান বিপর্যস্ত ভূরাজনীতি নতুন বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

×