সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। উপক‚লীয় অঞ্চল ঘিরে উঁচু উঁচু অদ্ভুতুড়ে ম্যানগ্রোভের ঘন ঝোপ, কাদামাটির বুক চিরে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা শ্বাসমূল। গাছের ডালে ঝুলে থাকা বানর, হরেক প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির ডাক। হরিণের সতর্ক অথচ কৌতুহলী চোখের চাহনি, কখনো বাঘের অস্পষ্ট পদচিহ্নের আভাস। গুটিগুটি পায়ে মধুর সন্ধানে এগিয়ে চলা মৌয়াল কিংবা ঘন অরণ্যের বুক চিরে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদীতে মাছ ধরার নৌকা— সবমিলিয়ে যেন এক নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, পশুর, ধুন্দল, গোলপাতা, কেওড়াসহ হরেক রকমের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের সমাহারে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে সুন্দরবন গঠিত। যার মোট আয়তনের প্রায় ৬৬ শতাংশ বাংলাদেশে এবং ৩৪ শতাংশ অবস্থিত ভারতে। এই বনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, কুমির, সাপসহ ৪৫৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে প্রায় ২৯০ প্রজাতির পাখি, ১২০ প্রজাতির মাছ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং আটটি উভচর প্রজাতির বসবাস।
বনের সারি সারি গরান উদ্ভিদ এবং জালের মতো বিস্তৃত নদ-নদীর স্থানীয় জীবন-জীবিকার উপর গভীর প্রভাব রয়েছে। বন থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিল্পের কাঁচামাল এবং জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করা হয়। কুটির ও ছাউনি নির্মাণে বন থেকে গোলপাতা ও ছন সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এ বন হতে প্রচুর পরিমাণে মধু, মোম ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ আহরণ করা হয়। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী থেকে ব্যাপকহারে মৎস্য, শামুক, ঝিনুক ও কাঁকড়া আহরণ করা হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখে।
সুন্দরবন কেবল বিশাল জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থলই নয়, এটি দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবেও কাজ করে। বাংলাদেশের শিয়রে অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালা যেভাবে উত্তরের শীতল বাতাসকে প্রতিরোধ করে দেশকে তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে, সুন্দরবনও যুগ যুগ ধরে সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস, আইলা, সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বুক পেতে দিয়ে উপক‚লীয় অঞ্চলকে রক্ষা করে আসছে। সমুদ্রে সৃষ্ট কোনো প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় তীব্র বেগে উপক‚লের দিকে ধেয়ে আসতে থাকলে, তা সুন্দরবনের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় বনের ঘন গাছপালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত স্বল্প বেগে লোকালয়ে প্রবেশ করে। এতে করে সুন্দরবন নিজে ক্ষতবিক্ষত হলেও লোকালয়ের মানুষজনকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। বিবিসি বাংলার তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবন ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার তাÐব থেকে উপক‚লীয় অঞ্চলকে রক্ষা করেছে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতেও ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপক তাÐব ঠেকাতে ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ জলোচ্ছ¡াসের তীব্র ঢেউয়ের উচ্চতা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, প্রাণ-প্রকৃতির এমন অব্যর্থ রক্ষাকবচ সুন্দরবন আজ নানামুখী চ্যালেঞ্জে জর্জরিত। সুন্দরবনের অদূরে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে উঠা, বিশেষকরে সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাবে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগ্রস্তের আশঙ্কা রয়েছে। নানামুখী চাপ ও আপত্তি সত্তে¡ও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের আগে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়েছিল, বাস্তবে এখন ধারণার থেকেও বেশি ক্ষতি হচ্ছে। সময় সংবাদের বরাতে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস দ্বারা পরিচালিত মূল্যায়নে এ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ নদীগুলো দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল এবং তা থেকে তেল, মবিল নিঃসরণ ও বর্জ্য নিক্ষেপণ বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরবনে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের বিকাশ বনের স্বাভাবিক পরিবেশে বিঘœ ঘটাচ্ছে। বনবিভাগের বিধিনিষেধ শিকেয় তুলে ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী নিয়ে বনের গহীনে প্রবেশ, জাহাজে উচ্চ শব্দে গানবাজনা বন্যপ্রাণীদের অনিরাপদ করে তুলছে। বনজ সম্পদ ধ্বংস, বৃক্ষনিধন, বনদস্যুদের দৌরাত্ম ও বণ্যপ্রাণী শিকারের ফলে বনের স্বাভাবিক পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
সুন্দরবনের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত সংবেদনশীল। এটি কোন সাধারণ বন কিংবা পর্যটনকেন্দ্র নয়। সুন্দরবনের অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীববৈচিত্র্য ও বিশ্বব্যাপী এর পরিবেশগত গুরুত্বের জন্য ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং রামসার স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ বন অনেক বিরল ও বিপন্নপ্রায় জীবের আবাসস্থল। যাদের সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এসকল প্রাণীদের রক্ষায় বন বিভাগের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভয়ারণ্য, বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। বন থেকে অবৈধভাবে গাছ কাটা, বন্যপ্রাণী শিকার ও বনজ সম্পদ লুটতরাজের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বনরক্ষীদের সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া বন সংলগ্ন এলাকায় অপরিকল্পিত শিল্পায়ন বন্ধ করতে হবে। বনের ভেতর দিয়ে ভারী নৌযান চলাচলে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরবন ভ্রমনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি সুন্দরবনকেন্দ্রিক সুপরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব টেকসই পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে হবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
সুন্দরবন আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রলয়ঙ্কারী প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্ভেদ্য দেয়াল হিসেবে কাজ করে। তাই এর সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে, তবেই বেঁচে থাকবে সুন্দরবন, রক্ষা পাবে বাংলাদেশ।
শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়