ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

কোকো: ক্রীড়াঙ্গনের নিঃস্বার্থ কারিগর ও দেশপ্রেমের অমর প্রতীক

মাহবুব নাহিদ

প্রকাশিত: ১৯:৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

কোকো: ক্রীড়াঙ্গনের নিঃস্বার্থ কারিগর ও দেশপ্রেমের অমর প্রতীক

আরাফাত রহমান কোকো

 

দেশ যখন ভুগছিল গণতন্ত্রের অভাবে, ফ্যাসিবাদের দুরারোগ্যে ধুঁকছিল তখন খুবই নীরবে বিদায় নিয়েছেন প্রিয় আরাফাত রহমান কোকো—কোকো শুধু একটি নাম নয় একটি অনুভূতি, একটি নিঃশব্দ সংগ্রাম। প্রচারের আড়ালে থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এক নিঃস্বার্থ কারিগর, অলিখিত কাণ্ডারি। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুনির্দিষ্ট—দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, বৈষম্য মুক্ত করা। শৈশবে মুখোমুখি হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার এবং জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সংগ্রাম ও ত্যাগ তাঁকে গড়ে তুলেছিল এক অনন্য অসাধারণ ব্যক্তিত্বে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার অবদান কেবল পরিসংখ্যানের সীমাবদ্ধ গল্প নয়, কিংবা কবিতার ডায়েরিতে লিখে রাখা দুই চারটা লাইন নয়; তা যেন ক্রীড়া সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়, অবিকল্প সারথি। নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য, ক্রীড়াঙ্গনের উন্নতির জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে তিনি কাজ করেছিলেন নিঃশব্দে। ২০১৫ সালে আজকের এই দিনে কোকো ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েও তিনি রয়ে গেছেন কোটি ক্রীড়াপ্রেমীর হৃদয়ে, ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি সাফল্যের মঞ্চে।


১৯৬৯ সালে করাচিতে জন্ম নেয়া ছোট্ট কোকো, যিনি মায়ের স্নেহে এবং পরিবারের স্বপ্নে বড় হয়েছিলেন, তাঁর জীবন বদলে যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ভয়ংকর সেই সময়ে ঢাকায় ফিরে আসা এবং মা ও বড়ভাই তারেক রহমানের সাথে পাকসেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর শৈশবের সরলতাকে চিরতরে মুছে দিয়েছিল। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশার দিনগুলো তার জীবনে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, যা তিনি কখনো প্রচারের আলোয় তুলে ধরেননি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হলেও, কোকো তাঁর নিজের লড়াই চালিয়ে গেছেন নিঃশব্দে। দেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য এত বড় অবদান, এত বড় ত্যাগ তবু নেই শব্দের আলোড়ন! জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে, প্রতিটি পদক্ষেপে দেশের প্রতি তাঁর নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং ক্রীড়াক্ষেত্রের প্রতি তাঁর গভীর নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞা তাঁকে আজও স্মরণীয় করে রেখেছে।
২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেমস ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আরাফাত রহমান কোকো ক্রিকেটের পেশাদার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে হাই-পারফরম্যান্স ইউনিট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে বহু তারকা খেলোয়াড়দের গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির প্রভাব কমিয়ে পেশাদারিত্বে রূপান্তরের এ প্রচেষ্টা বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করেন আরাফাত রহমান কোকো।

২০০৪ সালে আরাফাত রহমান কোকোর উদ্যোগে মিরপুর শেরে-বাংলা স্টেডিয়ামের আধুনিকায়ন সম্পন্ন হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের হোম ভেন্যু হিসেবে পরিচিতি পায়। তাঁর প্রচেষ্টায় স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়, যা দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপন করে। একই বছরে তাঁর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়, যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের ক্রিকেটের পরিচিতি বাড়াতে সহায়ক হয়। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন সক্রিয়—ওল্ড ডিওএইচ ক্রীড়া সংঘের চেয়ারম্যান এবং সিটি ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন।
আরাফাত রহমান কোকোর ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও দূরদর্শিতায় জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। তাঁর আন্তরিক অনুরোধে সংগীত শিল্পী আসিফ আকবরের কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল কালজয়ী গান "সাবাশ বাংলাদেশ," যা শুধু একটি থিম সং নয়, বরং কোটি ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের আবেগ, গর্ব আর একাত্মতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এই গান যেন কোকোর সেই স্বপ্ন আর ভালোবাসার প্রতিধ্বনি, যা দেশের ক্রিকেটের উত্তেজনা আর গৌরবকে প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। ক্রিকেট মাঠে সেই সুরেলা আবহ দেশজুড়ে আবেগ ও আত্মবিশ্বাসের জাগরণ ঘটিয়েছিল। তবে নির্মম বাস্তবতা থেমে থাকেনি; বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দমননীতির কারণে এই গানকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যেন তা কোথাও বাজতে না পারে। তবুও, "সাবাশ বাংলাদেশ" আজও বেঁচে আছে মানুষের হৃদয়ের গহীনে, কোকোর অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসার অমর স্মারক হয়ে।
আরাফাত রহমান কোকোর দূরদর্শী নেতৃত্ব বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ক্রিকেটকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। মিরপুর ও চট্টগ্রামের বাইরেও তিনি সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও রাজশাহীতে ক্রিকেটের প্রসারের জন্য বৈপ্লবিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যার মাধ্যমে স্থানীয় প্রতিভাগুলো উঠে আসার সুযোগ পায়। তার উদ্যোগে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক মানের ভেন্যুতে রূপান্তরিত হয়, যা দেশের ক্রিকেটকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি দেশীয় ক্রিকেটে বিদেশি কোচ, ট্রেনার এবং ফিজিওদের সম্পৃক্ত করেন, যা আন্তর্জাতিক মান উন্নয়নের দিগন্ত খুলে দেয়। পাশাপাশি, তিনি যোগ্যতাভিত্তিক বেতন কাঠামো প্রবর্তন করেন, যা ক্রিকেটারদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা এবং মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করে। কোকোর এই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত কেবল ক্রিকেটারদের জীবনমান উন্নত করেনি, বরং পুরো ক্রীড়াঙ্গনে পেশাদারিত্বের একটি নতুন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছে, যা আজও বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।

আরাফাত রহমান কোকোর জীবন ছিল এক নির্মোহ সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। ১/১১-পরবর্তী দুঃসময়ে কোনো অপরাধ বা অভিযোগ ছাড়াই তাকে কারাবন্দি করা হয় এবং নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সেই অন্ধকার দিনগুলোতেও তিনি ছিলেন অবিচল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আট বছর পর, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে, যখন তাঁর মা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলনে গুলশানের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন, বাড়ির সামনে ছিল বালির ট্রাক, সেই সময় বিদেশের মাটিতে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া বারবার মূর্ছা যান, কিন্তু ব্যক্তিগত শোককে অগ্রাহ্য করে জনগণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। কোকোর এই মৃত্যু কেবল তাঁর পরিবারের জন্য নয়, বরং পুরো দেশের জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে ওঠে। তার জানাজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, তিনি শুধু একজন ক্রীড়া সংগঠক নন, বরং জাতির হৃদয়ে স্থায়ীভাবে স্থান করে নেওয়া এক নির্মোহ দেশপ্রেমিক ছিলেন।
কোকোর মৃত্যুতে বাংলাদেশের মানুষ শুধু একজন ক্রীড়া সংগঠককে নয়, বরং এক সতত, নিরহংকার দেশপ্রেমিক যোদ্ধাকে হারিয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতি আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে গভীর শূন্যতার জন্ম দেয়। মানুষ আজও খুঁজে ফেরে তাদের প্রিয় কোকো ভাইকে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি সাফল্যে, প্রতিটি উচ্ছ্বাসে যেন তাঁর স্মৃতি ভাস্বর হয়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, কোকোর বড় ভাই তারেক রহমানের নেতৃত্বে একদিন বাংলাদেশ ক্রীড়াক্ষেত্রে হারানো জৌলুস ফিরে পাবে। দল-মত নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে একটি বৈষম্যহীন ক্রীড়া ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, আর বাংলাদেশ সমস্ত খেলাধুলায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কোকোর স্বপ্ন, তাঁর দূরদর্শী চিন্তা ও ভালোবাসা, একদিন সাফল্যের পতাকা হয়ে উড়বে প্রতিটি বাংলাদেশির হৃদয়ে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

ইসরাত

×