সংবিধান একটি দেশের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে
সংবিধান একটি দেশের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। সংবিধান হচ্ছে সেসব মৌলিক নিয়মকানুন এবং প্রথার সমষ্টি যা কোনো রাষ্ট্রের সরকারের বিভিন্ন বিভাগ অর্থাৎ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে। শাসকের ক্ষমতা বর্ণনা করে, শাসিতের মৌলিক অধিকার বর্ণনা করে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে এবং শাসক তার ক্ষমতার গণ্ডি লঙ্ঘন করে শাসিতের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে তার প্রতিবিধানের জন্য বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৭ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদে যে ১৮টি অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে মৌলিক অধিকার, যা প্রকৃতিগতভাবে আইনগত অধিকার এবং সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এগুলো আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য।
এই অধিকারগুলো ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র প্রতিকার প্রদানে বাধ্য থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ শিরোনামে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে, যার মধ্যে ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যা সাধারণভাবে ‘মৌলিক চাহিদা’ হিসেবে পরিচিত। সংবিধানের ৮ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত এই অধিকারসমূহ আদালতের মাধ্যমে প্রতিকারযোগ্য নয়।
মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকার কতটা সক্ষম তা নির্ভর করে দেশের সম্পদ ও অর্থনৈনিক অবস্থার উপর। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, সরকার অন্তত বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এই মৌলিক চাহিদা তিনটি পূরণের সামর্থ্য রাখে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন কোথায়? এই তিনটি জায়গাতেই বড় ধরনের দুর্নীতি লক্ষ্য করা যায়। দেশে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠদান করা হলেও এই শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বার বার কারিকুলাম পরিবর্তন, কারিকুলামের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করা, দক্ষ শিক্ষকের অভাব ইত্যাদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর যে বেহাল দশা সে সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ-ই নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত। তাদের পক্ষে সম্ভব না বেসরকারি হাসপাতালে হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা সেবা নেওয়া। তাদের আশা ভরসার একমাত্র জায়গা সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে তারা শুধু নাম মাত্র চিকিৎসাই পায়। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের চরম সংকট, পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ না করা, অপারেশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি সরকারি হাসপাতালগুলোর নাম ডুবিয়েছে। রোগীর হাতে কিছু প্যারাসিটামল ধরিয়ে দিতে পারলেই কাজ শেষ।
সরকারি চিকিৎসকদের মূল টার্গেটই থাকে প্রাইভেট হাসপাতাল। কারণ ওখানেই টাকার খনি। ওখানে সময় দিতে পারলেই লাভ। এদিকে গরীব দুঃখীরা মরলেও তাদের কিছু যায় আসে না। টাকার নেশায় অনেকেই তাদের পেশার মূল লক্ষ্যটাই ভুলে যায়। আবার সরকারি বিভিন্ন আশ্রয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির শেষ নাই। যাদের জন্য প্রকল্প তাদের খুব কম সংখ্যক মানুষই এই প্রকল্পের আওতায় আসতে পারে। নেতা,পাতিনেতা, প্রভাবশালীদের পকেটেই প্রকল্পের অধিকাংশ টাকা চলে যায়। গৃহহীন মানুষ, পথ শিশু তাদের প্রতি কি সরকারের দায়িত্ব নেই? তারা কি দেশের নাগরিক না?
অনেকে যে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে তাদেরকে সঠিক পরিচর্যা করা কি সরকারের দায়িত্ব নয়? তাদের কি মৌলিক অধিকার নেই? স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক উন্নয়ন সাধিত হলেও মানুষের স্বস্তির জায়গা, বেঁচে থাকার জন্য যে অধিকার দরকার, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সংকুচিত। গুম, ক্রসফায়ার, গায়েবি মামলা ইত্যাদি ঘটনা বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। এগুলো আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা দরকার।
দমনপীড়নের পথ পরিহার করলে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। এছাড়াও সা¤প্রদায়িকতা দূরীকরণ ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা কতদূর এগিয়েছে? এর হিসাব-নিকাশ কতটুকু হয়েছে? এই সবকিছুর উত্তর মিলবে সংবিধানের পরিপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে। তবেই প্রতিবছর ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস জাতীয়ভাবে পালন করার উদ্দেশ্য সফল হবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ