ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

পোশাকের চেয়ে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি

প্রজ্ঞা দাস

প্রকাশিত: ২০:০১, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

পোশাকের চেয়ে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি

পোশাক নয় মানুসিকতা পরিবর্তন জরুরি

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশ, র‌্যাব এবং আনসার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সাম্প্রতিক সময় অর্থাৎ জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে এই বাহিনীগুলোর কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছে। এসব বাহিনীর গর্হিত কিছু কার্যক্রমের জন্য মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা এবং আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বাহিনীর সদস্যদের আচরণ, দায়িত্ব পালনের ধরন এবং সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের নতুন পোশাকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তিন বাহিনীর ইউনিফর্ম বদল নিয়ে সরকারের যুক্তিÑ বাহিনীগুলোকে ঢেলে সাজাতে প্রতীকী এই পরিবর্তন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেছেন, বাহিনীর সদস্যদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। সে লক্ষ্যে পোশাক পরিবর্তন করা হচ্ছে। শুধু পোশাক নয়; বাহিনীকে জনবান্ধব করতে প্রশিক্ষণেও পরিবর্তন আনতে চায় সরকার।
 পুলিশের নতুন পোশাক হচ্ছে আয়রন বা লোহার রঙের; র‌্যাবের অলিভ বা জলপাই এবং আনসারের পোশাক হচ্ছে গোল্ডেন হুইট বা সোনালি গমের রঙের। পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে দাবি ওঠে মূলত জুলাই-আগস্টে বাহিনীটির বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে। ওই আন্দোলনে দুই হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা শহীদ হয়। আহত হয় ২০ হাজারের বেশি মানুষ। আওয়ামী গোষ্ঠীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার এই লড়াইয়ে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের পক্ষ নিতে হয় এ সকল বাহিনীকে। লড়াইয়ে জয়ী ছাত্র-জনতা পুলিশকে পরাজিত শক্তির দোসর হিসেবেই ভাবতে শুরু করে। ফলস্বরূপ ৫ আগস্টের পর প্রায় এক সপ্তাহ কোনো পুলিশসহ বাকি দুই বাহিনীকে মাঠে দেখা যায়নি। এ সময় দেশে বেশ অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করতে থাকে।
জনগণও নিরাপত্তা নিয়ে বেশ শঙ্কিত হয়। বাহিনীগুলোর সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী খারাপ হতে পারে না। শুধু আওয়ামী আমলে সুবিধাবাদী কর্মকর্তা কর্মচারী ছাড়া অন্যদের বিষয়ে সহজ হতে থাকে জনগণ। ফলশ্রুতিতে সরকারও চেষ্টা করে এ সকল বাহিনীকে কাজে ফেরানোর। তখন বাহিনীগুলোর ভিতর থেকেই আওয়াজ উঠে তারা আর ছাত্র জনতার রক্তে রঞ্জিত পোশাকে কাজ করতে চায় না। সাধারণ জনতাও এতে সায় দেয়। এবং সরকার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এ সকল বাহিনীর পোশাক এবং লোগো পরিবর্তন করা হবে।
অবশেষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় পোশাকের কালার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই পোশাকে রং, ডিজাইন নিয়ে অনেকের অনেক রকম বক্তব্য থাকতে পারে। তবে সচেতন নাগরিক এবং সর্বসাধারণ জনগণের ভাবনা অন্যদিকে। বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে ওঠা বিগত সময়ের অভিযোগগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে এটাই প্রত্যাশা। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে পুলিশকে তাদের নিযুক্ত লাঠিয়াল বাহিনী ভাবতে শুরু করে। পুলিশ রাষ্ট্রের বাহিনী। তারা কোনো ব্যক্তির শিষ্য বা দলের কর্মী নয়। এটি তাদের মাথায় রেখে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঔপনিবেশিক খাজনা আদায়ের লাঠিয়াল বাহিনী থেকে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের সেবকের ভূমিকায় পুলিশকে জনস্বার্থে কাজ করতে দিতে হবে।
সরকারের পতনের পর দেশে অন্তত এক সপ্তাহ পুলিশ ছিল না। তখন আমরা টের পেয়েছি, নগরবাসীর এক সুন্দর এবং নিরাপদ ঘুম নিশ্চিত করার পেছনে পুলিশ কত পরিশ্রম করে। তবে এটাও ঠিক এ সকল বাহিনীতে কিছু অতিউৎসাহী সদস্য থাকে। তারা বিভিন্ন সময় আন্দোলন দমাতে কমান্ডের বাইরে গিয়ে অপেশাদার আচরণ করে। এসব সদস্যকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এ সকল বাহিনীতে এখন উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে যোগ দিচ্ছে। এসব তরুণ নিজেরাও পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক হবে। বাহিনীগুলো আরও শক্তিশালী, ন্যায়পরায়ণ, জনগণের আস্থাভাজন এবং জনগণের সেবক করে গড়তে এই তরুণরাই বড় শক্তি হতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে প্রতিদিন সাধারণ মানুষ পুলিশ, র‌্যাব বা আনসারের সাহায্য চান, সেখানকার বাহিনীগুলোর দায়িত্ব শুধু শৃঙ্খলা রক্ষা নয়, বরং মানুষকে আস্থার জায়গা দেওয়া।
একটি বাহিনীর সদস্য যতই উন্নত পোশাক পরুক না কেন, যদি তাদের আচরণে দুর্নীতি, অবহেলা বা ক্ষমতার অপব্যবহার থাকে, তবে জনগণের মধ্যে তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব থেকেই যাবে। পোশাক বা বাহ্যিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সাময়িক দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব, তবে দীর্ঘমেয়াদে বাহিনীগুলোর আস্থা ও সম্মান অর্জন করতে হলে মানসিকতার পরিবর্তনই মুখ্য। এ পরিবর্তন আনতে হলে প্রয়োজন সচেতন নেতৃত্ব, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং কার্যকর জবাবদিহিতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যদি জনগণের সেবক হয়ে কাজ করে, তবে কেবলমাত্র তখনই একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এবং আস্থাপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

×