ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

চা শ্রমিকের যাপিত জীবন

সাবিবা ইসলাম অন্তি

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

চা শ্রমিকের যাপিত জীবন

পুরনো সংস্কৃতি ও সভ্যতাজুড়ে হাজার হাজার বছর ধরে চায়ের ইতিহাস বিদ্যমান রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতাব্দীতে চীনাদের হাত ধরেই ‘চা’ পর্যায়ক্রমে ‘তিক্ত উদ্ভিজ্জ’ বা ‘ঔষধি উদ্ভিজ্জ’ এবং চাইনিজ ভাষায় ‘তু’ হিসেবে জনপ্রিয় পানীয় হয়ে ওঠে। ইংরেজ ও ওলন্দাজ বণিকরা সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে চীন থেকে চা আমদানি করত। দফায় দফায় চীন ও জাপানের যুদ্ধ চলতে লাগলে এক সময় চা আমদানি বন্ধ হয়ে যায় এবং ইংরেজরা এর বিকল্প হিসেবে ভারতবর্ষকে চা উৎপাদনের উৎস হিসেবে বেছে নেয়। ১৮৪০ সালের দিকে ‘রয়েল সোসাইটি’ কমিশন পরীক্ষা করে সিলেট, কাছাড় জেলা ও অসমের লখিমপুরে চায়ের উৎপাদনে ব্যাপক বিস্তৃতি দেখতে পায়।
‘চা’ এমন একটি শিল্প যার দ্রুতবর্ধনশীলতার কারণে প্রচুর শ্রম ও শ্রমিকের দরকার হয়। ইংরেজরা এই শ্রমিকের জোগান দেওয়ার জন্য সেসময় ‘গাছ হিলায়ে গা তো পাইসা মিলেগা’ (গাছ নাড়লে টাকা মিলবে) এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, কানু ও তেলেগুসহ প্রায় ১১৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে। কম মুনাফায় অধিক লাভের এই চক্রে পড়ে যায় নিরীহ জনগোষ্ঠী। তাদের একদিকে যেমন পাহাড়ে-জঙ্গলে হিংস্র পশুর থেকে বাঁচতে হতো, অন্যদিকে অনাহারে-অসুখে জীবন ছিল একেবারে জর্জরিত। সে সময় আড় প্রথা চালু ছিল। সে সুযোগে চা ম্যানেজাররাও একচ্ছত্র নির্যাতনের সুযোগ পেত। কেউ কাজ করতে না চাইলে কিংবা পালিয়ে গেলে তার জন্য দণ্ডনীয় শাস্তি বরাদ্দ ছিল। এমনকি চা-বাগানে শ্রমিকের মৃত্যু ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনারই অংশ।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশরা শ্রমিক পাঠানোর গতি ত্বরান্বিত করার জন্য ‘ফ্রি কনস্ট্রাক্টরস’ পদ্ধতি চালু করেছিল, যা ছিল এক ষড়যন্ত্র! কৃষিজ ফসলের ওপর উচ্চ কর আরোপ করা হলো এবং আড়কাঠিরা (স্থানীয় জনবল) গরিবদের সহজ সরল ছেলেমেয়েদের লোভ দেখিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে ‘কুলি’ হিসেবে জাহাজের ডিপোয় তুলে দিত। যেখানে আসনসংখ্যার ১০গুণ শ্রমিককে জায়গা দেওয়া হতো। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে টিকে থাকার লড়াই শুরু হওয়ার আগে অনেক শ্রমিকই মারা যেত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনেই ছিল বেশিরভাগ চা-বাগান। পরবর্তীতে ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে, চা-শ্রমিকরাও কিছুটা ‘আশার আলো’ খুঁজতে থাকেন।
১৯২০ সালের দিকে শ্রমিকরা বিদেশী মালিকদের বাণিজ্য ও চা-বাগান বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাগান থেকে দলে দলে বেরিয়ে পড়তে শুরু করেন। ১৯২১ সালে রাজনৈতিক আন্দোলন ও চা-শ্রমিকদের শোষণবিরোধী আন্দোলন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সিলেট ও কাছাড়ের প্রায় ৩০,০০০ শ্রমিক ‘চরগোলা এক্সোডাস’ আন্দোলনে অংশ  নেওয়া শোষিত চা-শ্রমিকরা অসমের চরগোলা ও লঙ্গাই উপত্যকা থেকে বেরিয়ে নিজ আবাসে (মুল্লুকে) ফেরত যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিল। যা ইতিহাসে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত এক ঘটনা হিসেবে রয়ে গেছে ‘মুল্লুকে চলো আন্দোলন’।
সেই কবে ব্রিটিশ আমলের শেষ হয়েছিল। তবে চা-বাগানে শ্রমিকদের ওপরে হওয়া নিপীড়ন কী বন্ধ হয়েছে? স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমরা পা দিয়েছি, কিন্তু সেই স্বাধীনতা কী চা-শ্রমিকরা ভোগ করছেন? এসব প্রশ্ন জাতির সুশীল নাগরিকদের ভাবা উচিত। বাংলাদেশের প্রায় ২৫০ টি চা-বাগানের ৯০ শতাংশ রয়েছে সিলেট বিভাগে। চট্টগ্রামে ও বর্তমানে পঞ্চগড় জেলায়ও কিছু চা বাগান ও ফ্যাক্টরি রয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট অবধি একজন চা-শ্রমিকের দিনমজুরি ছিল ১২০ টাকা। চা-শ্রমিকের বিক্ষোভের মুখে তৎকালীন সরকার তা বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করে দেয়। ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী, নিবন্ধিত চা-শ্রমিকের সংখ্যা এক লক্ষ তিন হাজারের বেশি এবং অস্থায়ী চা-শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাঁইত্রিশ হাজার। বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিকরা ‘প্রভিডেন্ট ফান্ড’, রেশন, চিকিৎসাসেবা ও বেতনসহ ছুটি পেলেও অস্থায়ী শ্রমিকরা এর কিছুই পান না। এ যেন বৈষম্যের মধ্যে আবার ‘বৈষম্যে’!
চা-শ্রমিকের অধিকাংশই নারী। অথচ বেশিরভাগ চা-বাগানেই তাদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা নেই। তাদের টয়লেট থাকে না। সময়বিশেষ ঠিকমতো খাবার-পানিও সরবরাহ করা হয় না। নারী শ্রমিক অনিতা ভক্তি তার শিশুর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে পেটের ক্ষুধা নিবারণ হয় না, সেখানে ব্যাগ টেনে ভোরে বিদ্যালয়ে প্রবেশ না করে, খাঁচি কাধে চা-বাগানে প্রবেশ করতে হয়! হাতে গোনা কয়েকটি বিদ্যালয় রয়েছে, তাতেও নেই শিক্ষক! এসব চা-বাগানে কলেজের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
পুরো সিলেটের চা-বাগানগুলোজুড়ে সন্ধ্যা থেকে রাত নেমে এলেই মাদক সেবনকে ঘিরে আরও এক অন্যতম উদ্যাপন চলে বলা যায়! এই প্রথা ব্র্রিটিশরাই চালু করে দিয়ে গিয়েছিল। ঘরের পুরুষরা দেশীয় মটের পাট্টায় হাঁড়িয়া-চোলাই মদের ব্যবসা করে এবং এগুলো সেবন করে ঘরে-বাইরে করে অশান্তি। যেহেতু সিলেট অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট, এখানে প্রচুর রিসোর্ট ও হোটেল আছে। অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত ট্যুরিস্টদেরও মাঝেমধ্যে এসব কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে ভুগতে দেখা যায় অনিরাপত্তায়।
শ্রম অনুযায়ী, ‘চা-শ্রমিকরা এখনো কেবল জাতীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন করতে পারেন’। অন্যান্য পেশার শ্রমিকের মতো তাদেরও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একাধিক ইউনিয়ন থাকা উচিত। তাদের বহুমুখী সমস্যা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের গতি সেক্ষেত্রে ত্বরান্বিত হবে। চা-শ্রমিকরা কল্যাণ তহবিলের কোনো লভ্যাংশ পান না। স্থায়ী শ্রমিকদের এর অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে। অস্থায়ী শ্রমিকদের নির্দিষ্ট সময় কাজ করার ভিত্তিতে স্থায়ী শ্রমিকে নিবন্ধিত করতে হবে। বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ মোতাবেক, চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আলোচনায় অসুস্থতার ছুটি, গ্র্যাচুইটিসহ বিমার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা ছিল। আজও অনেক আদিবাসী চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর নিজের কোনো আবাসস্থল নেই।
বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক ‘চা শিল্পের উন্নয়নে পথ নকশা’ নামক প্রকল্পে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। তাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তাতে ১৫ হাজার শ্রমিক বাসস্থান ইউনিট, শৌচাগার স্থাপন, মাদ্রাসা ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা আরোপণের বিভিন্ন নীতিমালা ছিল। ২০১৮ সালে ‘সুপেয় নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন শীর্ষক’ আরও একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। যার ব্যয় ছিল ৬১ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা। এত কর্মসূচি নিলেও চা-শ্রমিকের সন্তানদের শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি তেমন একটা। সোস্যাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) বলছে, ‘চা-শ্রমিকের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এখনো চা-শ্রমিকরা বাংলাদেশের সব চাইতে অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত ও শোষিত গোষ্ঠী’।
শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। সিলেট জেলা শহরের হিসাবে ১৯.৩% শিশু শ্রমিক চা বাগানে রয়েছে। চা বাগানে প্রতি ২৫ শিশুর জন্য একটা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল মালিকদের। অথচ এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৪-১৫ টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩ টি। নেই কোনো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে, একজন শিশুর শিক্ষাবাবদ মাসিক ৪৫ টাকা ব্যয় করা হয়, যা খুবই নগণ্য! চা-শ্রমিক সন্তানের শিক্ষাবাবদ আরও অনেক  পরিমাণে ব্যয় করতে হবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, যাতে করে শিশুদের জীবন তাদের বাবা-মার মতো না হয়।
যুবসমাজকে মাদক থেকে রক্ষা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইন প্রণয়নেই শুধু মুখ্য ভূমিকা পালন করলে হবে না, এর সুশাসনও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব অঞ্চলে দেখা যায়, পুলিশ ও আইনের লোকেরা মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে যথেষ্ট পরিমাণ কমিশন পেয়ে তাদের ব্যবসায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
চা ‘কুলি’ থেকে চা ‘শ্রমিক’ হলো তারা যাদের জীবন তাদের কেটে ফেলা চা-পাতা গাছের মতোই রয়ে গেল। এই দুষ্টচক্র থেকে তাদের বের হওয়া কোনোমতেই সম্ভব হচ্ছে না। চা-শ্রমিকদের প্রতি সরকারের বিশেষ দেখভালের দরকার রয়েছে। এর সঙ্গে গবেষণা, গণমাধ্যম, বিভিন্ন জাতীয় সেমিনার ও সভায় আমরা চা-শ্রমিকের জীবন ব্যবস্থাকে মূলধারায় সমস্যা হিসেবে নিয়ে আসতে পারি, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে সহায়ক।

×