ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ

বিশ্ব সভ্যতা পরিবর্তনশীল। এ সভ্যতার কল্যাণেই বহু দার্শনিক তত্ত্বের উদ্ভব। যুগের চাহিদা ও সময়ের আবর্তে এরূপ তত্ত্ব বা মতবাদের আবির্ভাব। মানব সভ্যতার গতিশীলতা আনয়ন ও বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে অনেক যুগান্তকারী মতবাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। সম্প্রতিক বিশ^বাসীর কাছে ‘থ্রি জিরো’ শিরোনামে একটি তত্ত্ব উত্থাপিত হয়েছে। থ্রি জিরো বা তিন শূন্য তত্ত্বটি বর্তমান বিশ্বে বেশ প্রশংসিত। এ মানবকল্যাণমূলক তত্ত্বের উদ্ভব বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে। বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনকে ঘিরে তিন ‘শূন্য’ তত্ত্বের ধারণা। এ ধারণা প্রদান করেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতির গর্ব ও অহংকার! দেশের বর্তমান সরকার প্রধানই ‘তিন শূন্য’ তত্ত্বের প্রবর্তক। জাতি আজ উচ্ছ্বসিত! প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস মানবকল্যাণে বিশ্ববাসীর কাছে একটি দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন।
তিন ‘শূন্য’ তত্ত্বের ধারণা প্রথম উত্থাপিত হয় রাজধানী ঢাকার চীন-মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস-২০১৫’ উদযাপন কালে প্রধান বক্তার বক্তৃতায় এ তত্ত্ব প্রদান করেন। তাঁর মতে, পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্ববাসীকে তিন শূন্যের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। যার মাধ্যমে কিছু আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশ উন্নয়নবিষয়ক সূচক অর্জন করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যের মাত্রায় নিয়ে আসা। এ লক্ষ্য অর্জিত হলেই বিশ্ব টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। প্রফেসর ড. ইউনূস এ তিন শূন্য অর্জনে চারটি মহাশক্তির কথা বলেছেন। এ চারটি বৃহৎ শক্তি হচ্ছে- তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। এ শক্তিসমূহ শূন্যতত্ত্বের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। মানুষ মাত্রই অপরসীম ক্ষমতার অধিকারী এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য তাকে সৃজনশীল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন, প্রত্যেক ব্যক্তির উদ্যোক্তা হওয়ার সক্ষমতা আছে। তাই মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মসৃজন প্রয়াসী হতে হবে। তরুণদের ভাবনায় নিজেকে চাকরি প্রার্থী নয়, বরং চাকরিদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবেই দেশে কর্মসংকট দূর হবে এবং বেকারত্বের নিরসন ঘটবে।
অতি সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন-২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘কপ-২৯ এর ওয়ার্ল্ড লিডার্স ক্লাইমেট সামিটে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘থ্রি জিরো বা তিন শূন্য’ তত্ত্বকে বড় করে তুলে ধরেন। তিনি মন্তব্য করেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। সমগ্র বিশ্ব ক্রমাগত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে। আমাদের বর্তমান জীবনশৈলী পরিবেশবান্ধব নয়। বরং প্রত্যেকে নিরন্তর ভোগবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। অধিক সম্পদ আহরণ, অতিমুনাফা অর্জন এবং লাভের শেষ সীমায় পৌঁছানো যেন জীবনের একমাত্র ব্রত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করেন, শূন্য তত্ত্ব এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। এতে গড়ে উঠবে সবার জন্য বাসযোগ্য এক নতুন পৃথিবী। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন প্রযুক্তির প্রসার ও তারুণ্যের শক্তিকে সম্পৃক্ত করা। তরুণদের জীবনধারায় নবশক্তির সঞ্চার করতে হবে। তাদের পরিবর্তন করতে হবে চিন্তার ক্ষেত্রে ও জীবনধারা বা লাইফস্টাইলে। এ ধরনের পরিবর্তন তারা মানবকল্যাণার্থে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে। প্রত্যেক তরুণ হবে ‘থ্রি জিরো পারসন সিটিজেন’। অর্থাৎ তারা কার্বন নিঃসরণ করবে না, সম্পদ মজুতের আবর্তে সামাজিক ব্যবসা করবে এবং উদ্যোগী হবে বেকারত্ব দূরীকরণে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একান্ত ভাবনা- দারিদ্র্য বিমোচন, বেকারত্ব নিরসন ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা। তাতেই চিন্তাহীন ও নির্মল বিশ্ব গড়ে উঠবে।
বিশ্বায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও তিন শূন্যতত্ত্বের ধারণা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। এখানে বিশ্বায়ন হচ্ছে, একটি সীমানাহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক প্রয়োজনে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। যার মূল লক্ষ্য, বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থা জোরদার করা। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রসমূহ অতি দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় মগ্ন। ধনিক রাষ্ট্রসমূহ পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার, কারখানার কালো ধোঁয়া সৃষ্টি, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার,  প্রাকৃতিক সম্পদ অবাধে আহরণ ও  জলজ সম্পদ নিধনসহ নানা উপায়ে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করার ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া অনেকাংশে দায়ী। উন্নত রাষ্ট্রসমূহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিন্ত লাভজনক প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্র হিসেবে দুর্বল বা অনুন্নতকে প্রলুব্ধ করছে। ব্রাজিলের রিওডি জেনিরো শহরে সংকটাপন্ন বিশ্বকে আসন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৯২ সালে প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বিশ্বের ১০১টি দেশের সরকার প্রধানসহ ৭০ হাজার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ১৯৯৭ সালে, জাপানের কিয়োটো শহরে ১৯৯৭ সালে ও আফ্রিকার জোহান্সবার্গ শহরে ২০০২ সালে আয়োজন করা হয়। জাতিসংঘের এরূপ সম্মেলন আয়োজনের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্ববাসীর দারিদ্র্য দূরীকরণ, বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ। সময়ের আবর্তে ধরিত্রী সম্মেলনসমূহ ও তিন শূন্যতত্ত্বের লক্ষ্য অর্জন যেন টেকসই বিশ্ব গড়ার সমন্বিত প্রয়াস।
জাতিসংঘ ২০১৫ সালে একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা সদস্য রাষ্ট্রসমূহের কাছে পেশ করে। এসডিজি নামক পরিকল্পনার অন্যতম একটি লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য টেকসই বিশ^ প্রতিষ্ঠা করা। ‘এসডিজি-২০৩০’ হচ্ছে একটি সর্বজনীন ও একগুচ্ছ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা। এগুলোর মধ্যে আছে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা। এডিজির লক্ষ্যসমূহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, যার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিটি রাষ্ট্রের টেকসই ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে। এ পরিকল্পনা হচ্ছে বিশ্বের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতসমূহ মোকাবিলা করে একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার অঙ্গীকার। ২০১৫ সালেই শূন্য তত্ত্ব ও এসডিজির লক্ষ্য বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘শূন্য তত্ত্ব’ হচ্ছে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রদত্ত ব্যক্তিগত মতবাদ। বিশ্ব সুরক্ষায় প্রদত্ত এ দার্শনিক মতবাদ এডিজির সামগ্রিক লক্ষ্যসমূহের সমন্বিত রূপ। আমাদের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্লোবাল সেলিব্রেটির শূন্য তত্ত্বের ধারণা থেকেই বিশ্ববাসী এডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়নের অনুপ্রেরণা পাবে।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থায় মন্দাভাব পরিলক্ষিত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতির সার্বিক উত্তরণের লক্ষ্যে লেবার পার্টির পুনর্গঠন বিষয়ক মন্ত্রী আর্থার গ্রিনউড ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত মতে, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম হেনরী বিভারিজের নেতৃত্বে (Inter Departmental Committee on Social Insurance & Allied Services) শীর্ষক কমিটি গঠন করা হয়। বিভারিজ কমিশনের রিপোর্ট আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে আর্থনৈতিক সংস্কারসাধন ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আজও একটি আদর্শ মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভারেজ কমিশনের রিপোর্ট সমাজের অগ্রগতির পথে ৫ (পাঁচ) টি অন্তরায় চিহ্নিত করেছিল। চিহ্নিত অন্তরায়সমূহ অভাব, রোগব্যাধি, অজ্ঞতা, মলিনতা ও অলসতা। যা পঞ্চদৈত্য হিসেবে বিবেচিত। গত শতাব্দীর সমস্যা ও বর্তমান শতকের সংকটের ধরণে বহুলাংশে মিল রয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় বর্তমান শতকের সকল সমস্যাকে অতিমাত্রায় শঙ্কিত করেছে। তাই তিন শূন্য তত্ত্বের লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ রচনা করা সম্ভব হয়। তরুণ প্রজন্মের মাঝে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে হবে। রাষ্ট্র পক্ষসমূহকে তরুণ্যের চিন্তাশক্তির প্রসারে হতে হবে তৎপর।
বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার মহান অঙ্গীকার। একদিন তরুণ প্রজন্ম শপথ নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। স্বাধীন করেছিল বাংলাদেশ। উৎসর্গ করেছে জীবন। কিন্তু শহীদের বিসর্জন ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার পরিচালনাকারীগণ বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের শপথের অঙ্গীকার যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা স্বাধীনতার সুবিধাভোগী কিংবা হননকারী হিসেবে অতি মুনফা, লুণ্ঠন, দুর্বৃত্তায়ন ও মুদ্রা পাচারে লিপ্ত হয়েছে। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের প্রাথমিক ফল থেকে বাংলাদেশের জনগণের আয়-বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯৯ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ হিসেবে অতিদ্রুত বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্সের ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ প্রতিবেদন-২০১৮’ মতে, এ দেশে অতি ধনীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি তরুণসমাজ বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে দেশে একটি গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছে। আশা করা যায়, এ বিপ্লবের ফলে শূন্যতত্ত্বের বাস্তবায়ন হবে গতিশীল। দেশের দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসংস্থান সংকট দূর হবে। রাষ্ট্র সংস্কার ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা হোক সকলের অঙ্গীকার।


লেখক : অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, আগারগাঁও
[email protected]

×