অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিতাড়িত সরকার অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি ছোবড়া অর্থনীতি রেখে গেছে। তাদের স্বার্থান্বেষী সিদ্ধান্তের কারণেই দেশের সব খাত এখন রয়েছে গুরুতর সংকটে। সংকট-বিপর্যয় আরও না বাড়াতেই ছাত্র-জনতা দেড় দশক ধরে প্রবল প্রতাপে শাসন করা একটি সরকারকে পালাতে বাধ্য করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে নির্মোহ পরিচয়ের একদল মানুষসমৃদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকারকে, যাকে তারা স্বাধীনতার পরের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ও দেশপ্রেমিক মনে করছে। তাই সীমাহীন প্রত্যাশাও জন্মেছে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের ৫ মাস ১২ দিন বা ১৬৫ দিন পর জনগণের কারও কারও মনে হচ্ছে, ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বান্ধিলুঁ/অনলে পুড়িয়া গেল।/অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে/সকলি গরল ভেল।’ কথাগুলো বলার কারণ, অনেক ভালোবাসা-প্রত্যাশার এই সরকার একের পর এক এমন সিদ্ধান্ত-পরিকল্পনা হাজির করছে, যাতে তাদের মনে হচ্ছে ‘বিশ^াসের মা মরে আসলে গেছে’, ‘সকলই গরল ভেল’। এর সঙ্গে আবার পচে যাওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাড়া-মহল্লায় সদর্প তার অস্তিত্ব জানাচ্ছে। জনগণের বিশ^াসের পরিমাণ মূল্যায়নের জন্য ১৬৫ দিন কম হলেও মনে রাখতে হবে, ১৫ সেকেন্ডে একটি কলমে স্বাক্ষর দিয়ে যে দুয়েকটি সিদ্ধান্তের জানান তারা দিয়েছে; তা তাদের জাতপাত ও কর্মধারাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এর প্রমাণ, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতের লুটেরাদের দায়মুুক্তি ও কর্মকাণ্ড বজায় রাখতে (‘উক্ত আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তির অধীন চলমান কোনো কার্যক্রম এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে অথবা নিষ্পন্ন করিতে হইবে যেন উক্ত আইন রহিত হয় নাই’, অধ্যাদেশ নং ১৫, ২০২৪; ২৮.১১.২০২৪) অধ্যাদেশ জারি করেছে, নতুন করে ভ্যাট আরোপ করেছে, আর এখন শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও এ রকম ‘ছোটখাটো’ আরও পদক্ষেপ সরকার নিচ্ছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কারা এসব দুষ্ট বুদ্ধি দিচ্ছে জনপ্রিয় ও অনেক প্রত্যাশার এই সরকারকে।
বিগত সরকারের কমিশন ও লুটেরা বাণিজ্যে এমনিতেই দেশে বিদু্যুৎ-গ্যাস সংকট ক্রমশ বেড়েছে। এসব থেকে উত্তরণের পথ বের করতেই তো জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। তারা দায়িত্ব নেওয়ার পর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রের সময় বাড়িয়ে উন্মুক্ত করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বানেরও উদ্যোগ চলছে। আরও কিছু পদক্ষেপ সরকার খতিয়ে দেখছে। কিন্তু এর মধ্যেই জ্বালানি বিভাগের অনুমোদন নিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে বছরের শুরু থেকেই তোড়জোড় শুরু করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এ জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করা, নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাসবিল হবে নতুন দামে এবং পুরনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় থাকবে। একবার ভেবে দেখুন, একদিকে সর্বত্রই গ্যাসের সরবরাহ কম, অন্যদিকে নতুন শিল্পকারখানায় দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব; তা-ও আবার বৈষম্য সৃষ্টিকারী পুরনো শিল্প ও নতুন শিল্প গ্যাসমূল্য নির্ধারণ। যেখানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের মধ্যগগনে থাকা বেকার জনগোষ্ঠী ভরা দেশে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন ও ব্যাপক সম্ভাবনাও রয়েছে, সেখানে নতুন শিল্পকে দ্বিগুণ দামে গ্যাস কিনতে বলা। এতে যে নতুন শিল্প পুরনোদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না, বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী হবে নাÑ সে কথা তো দুধের বাচ্চাদেরও না বোঝার কথা নয়। অথচ এসবই করার পরিকল্পনা চলছে। উপরন্তু সরকার ইতোমধ্যেই কিছু বৈষম্য উদ্রেককারী পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ধনী ও প্রভাবশালীদের পক্ষেই যাচ্ছে। অথচ জনগণ এই সরকারকে বৈষম্য নিরসনের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে। এ অবস্থায় কেউ যদি প্রশ্ন করে, বৈষম্যের জন্য শিশু-কিশোর-তরুণরা প্রাণ দিয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারকে উচ্ছেদে ভূমিকা রেখে কি মহাপাপ করেছে, তা নিশ্চয়ই অমূলক হবে না। সরকারকে যেখানে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি তরল গ্যাস আমদানির পরিমাণ বাড়াতে হবে, চালু গ্যাসক্ষেত্র থেকে আরও বেশি গ্যাস উত্তোলন করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে এবং ভোলার গ্যাস দেশের অন্যান্য স্থানে এলএনজির মাধ্যমে সরবরাহের কাজটিও জোরদার করা যায় কি না, দৈনিক গড়ে ৪.৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌরবিকিরণ লাভকারী বাংলাদেশে সৌরশক্তি-বায়োগ্যাস-বায়োমাসের নবায়নযোগ্য জ্বালানির দ্রুত বিকাশে দৃষ্টিযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে; সেখানে তারা সহজ অর্থ আয়ের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। কি যে এক তুঘলকি কর্মকাণ্ড চলছে! ভাবতেও অবাক লাগছে!
এটি বহু পরীক্ষিত যে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর পেছনে আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলার যুক্তি এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি ধোপে টেকেনি। ২০১৮ সাল থেকে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করা হলেও সরবরাহ সংকট কাটেনি, নতুন কূপ খোঁজারও কিছু হয়নি। মন্ত্রী-আমলা-ধনী ও সরকারি কর্মচারী-অধ্যুষিত এলাকা ছাড়া রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ এলাকাজুড়ে বাসাবাড়িতে শীতকালে চুলা জ¦লে তাপহীন মিটমিটে গ্যাসে, অথচ গ্যাসের বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। শিল্পকারখানায়ও শীত-গ্রীষ্মে গ্যাসের সংকট দীর্ঘদিন ধরে। এর ওপর এখন আবার মূল্যস্ফীতি-ভ্যাটবৃদ্ধি-সংকটের মধ্যে নানা আয়-ব্যয়ের খতিয়ান দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছে পেট্রোবাংলা। নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাসবিল নতুন দামে নির্ধারিত হবে। তবে পুরনো গ্রাহকদের ক্ষেত্রে কিছুটা দয়া-দাক্ষিণ্যের সুযোগ থাকবে। এই প্রস্তাবটির গভীরতা বুঝতে হলে সার্বিক চিত্রটি উল্লেখ করতে হবে। শিল্পে দুই ধরনের গ্যাস সংযোগ রয়েছে, বয়লার পরিচালনা ও নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্যাপটিভ সংযোগ। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শিল্পে অনুমোদিত লোডের চেয়ে ১৪ কোটি ৭৮ লাখ ঘনমিটার বেশি গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে। ক্যাপটিভে এ সংখ্যা ৫ কোটি ৭৬ লাখ ঘনমিটার। নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে অতিরিক্ত ব্যবহৃত গ্যাসের জন্য নতুন দামে বিল পরিশোধ করতে হবে। পেট্রোবাংলা দাম বাড়ানোর পেছনে যুক্তি দিচ্ছে, দেশীয় গ্যাসের ইউনিটপ্রতি খরচ ৬ টাকা ৭ পয়সা হলেও আমদানি করা এলএনজির খরচ ৭৫ টাকার বেশি। ফলে, লোকসানে থাকা পেট্রোবাংলা এই ব্যয় শিল্প গ্রাহকদের ওপর চাপাতে চায়। চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) এলএনজি আমদানির কারণে ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকার ঘাটতি হতে পারে বলছে পেট্রোবাংলা। প্রশ্ন হচ্ছে, বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ-প্রয়োজনীয়তায় সরকারি আমলাদের পেট্রোবাংলার ঘাটতির কথা মনে পড়ল। অথচ দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই মূল বেতনের সঙ্গে ১০-২০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা বৃদ্ধির নামে জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা চাওয়ার কথা মনে রইল না। সমাজে এলিট শ্রেণি ভাব নিয়ে চলা ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীর জন্য প্রতিবছর বাজেটে বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ ৬-৮ শতাংশ বাড়ে। সেই হিসেবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দাঁড়াতে পারে প্রায় সাড়ে ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে মহার্ঘ্য ভাতায় ১০ হাজার কোটি টাকা যোগ হলে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হবে প্রায় লাখ কোটি টাকা। জনগণের ঘাম-শ্রম দিয়েই এসব এলিট শ্রেণি প্রতিনিধি ভালো থাকছে। তারপরও তাদের নজর পড়েছে নতুন শিল্প-কলকারখানা সৃষ্টির সম্ভাবনার দিকে। অন্তর্বর্তী সরকার তার ভাবর্মূতি ও শুদ্ধতার পরিচয় দিয়ে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে, বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক অনেক দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী মাতৃভূমিতে বিনিয়োগের চিন্তাও করছে। এর মধ্যেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির খবর চারদিকে চাউড় করে দেওয়া। কারা, কাদের, কিসের স্বার্থে এসব করছেÑ ওয়াকিফহাল মহলের তা অজানা নয়। তারপরও এসব চলছে। সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! বৈষম্য-শোষণের অবসান চেয়ে জনগণ তবে কি পাপ করেছে! তা-না হলে শিশু-কিশোরের অনেক শ্রদ্ধার, অনেক আশার এই সরকারের খ্যাতিমান ‘স্যার ও বড় ভাই’বৃন্দের সামনেই এসব তুঘলকি কর্মকাণ্ড চলছে। কিভাবে তাঁরা প্রশ্রয় দিচ্ছেন একে!
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষত তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে বড় প্রভাব পড়বে। স্থানীয় বাজারেও গ্যাসনির্ভর পণ্যের দাম বাড়বে। এই সিদ্ধান্ত শিল্পায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, কর্মসংস্থানও হ্রাস করবে। এমনিতেই শিল্পে সরবরাহ সংকট চলছে। বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের অনুমোদিত লোড ৫৩৫ কোটি ঘনফুট, যেখানে চাহিদা ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সর্বোচ্চ সরবরাহ ২৮০ থেকে ৩০০ কোটি ঘনফুট। ফলে, দৈনিক ঘাটতি ১০০-১২০ কোটি ঘনফুট। দেশীয় উৎপাদন কমতে থাকায় এবং নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রগতি না হওয়ায় শীঘ্রই এ সংকট কাটার সম্ভাবনা কম। এমন অবস্থাতেই রুগ্ন শিল্পধারায় গড়ে ওঠা দেশের সবেধন নীলমণি শিল্পে রাহুর নজর পড়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্পকে প্রতিযোগিতা সক্ষম রাখতে চাইলে, মনেপ্রাণে রপ্তানি বাড়াতে চাইলে, আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের আয়ের অন্যতম উপায় রপ্তানিকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে যতই প্রয়োজন ও চাপাচাপি হোক. এখন গ্যাস থেকে মুনাফা করার নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিতে হবে। কারণ, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে শিল্পসহ সংশ্লিষ্ট অনেক খাত। বিশ^ প্রেক্ষাপটে শিল্প খাতে গ্যাস ও জ্বালানি সংকট দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সেটি প্রমাণিত। এর ফলে যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা হ্রাস, রপ্তানিতে নেতিবাচক ধারা, কর্মসংস্থান হ্রাস, বিদেশী বিনিয়োগে স্থবিরতা, সরবরাহ চেইনের ব্যাঘাত, প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বাধা, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি, পরিবেশ ও নীতিমালাসংক্রান্ত জটিলতা বৃদ্ধি প্রভৃতি।
গ্যাস বা জ্বালানির সংকট হলে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি উৎপাদন খরচকে প্রভাবিত করে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষ করে যখন প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো সস্তা জ্বালানি সরবরাহ পায়। রপ্তানিমুখী শিল্প যেমনÑ টেক্সটাইল, গাড়ি ও ইলেকট্রনিকস খাত গ্যাস সংকটে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, এশিয়ার গার্মেন্ট খাত বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি রপ্তানি আয়ে প্রভাব ফেলে। জ্বালানি সংকটের কারণে অনেক কারখানা আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, যা ব্যাপক বেকারত্ব ডেকে আনে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে শ্রমিকদের বড় অংশ গ্যাসনির্ভর শিল্পে কর্মরত, তাদের আয়-রোজগার অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের কারণে দেশ বিনিয়োগে অনাকর্ষণীয় হয়ে পড়ে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এমন পরিবেশ পছন্দ করেন, যেখানে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ ও স্থিতিশীল খরচ নিশ্চিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার কয়েকটি দেশে জ্বালানি সংকট বিদেশী বিনিয়োগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানি সংকট শিল্প উৎপাদনের সময়সূচি ব্যাহত করে এবং পণ্যের সরবরাহ চেইনে তৈরি করে দীর্ঘসূত্রতা। ফলে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের ইউরোপীয় জ্বালানি সংকটে অনেক শিল্পকারখানার সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছিল। গ্যাসনির্ভর শিল্পে সংকট থাকলে নতুন প্রযুক্তি ও উৎপাদন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন চলে ধীরগতিতে। পুনর্বিকীরণযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর করার সুযোগ থাকলেও তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ, চীনের কয়লা সংকট তাদের শিল্প উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। জ্বালানি সংকটের ফলে পণ্য উৎপাদনে খরচ বেড়ে যায়, যা ভোক্তাপর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। এটি সাধারণ মানুষ ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ত্বরান্বিত করেছিল। জ্বালানি সংকটের কারণে অনেক দেশ আবার কয়লা বা অন্যান্য দূষণকারী শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে গ্যাস সংকটের সময় কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পরিবেশবাদীদের সমালোচনার মুখে পড়ে। তথাকথিত উদারনৈতিক বিশ^ব্যবস্থায় একটি দেশের গ্যাস ও জ্বালানি সংকট শুধু একটি দেশেই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শিল্প খাতে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক বাজারের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। এতটার পরও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা যদি গ্যাসের দাম বাড়াতে চান, তাহলে কিছু বলার নেই। শুধু প্রত্যাশা রইল, যাতে সময় থাকতে শুভ বুদ্ধির উদয় হয়।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়