ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ

অস্ট্রেলিয়া ডে, স্মৃতি  বর্তমান ভবিষ্যৎ

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২১:০৫, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

অস্ট্রেলিয়া ডে, স্মৃতি  বর্তমান ভবিষ্যৎ

সিডনির মেলব্যাগ

একটা কথা মানতেই হবে, আমাদের তারুণ্য মেধাবী। তাদের মেধা আর শ্রম এক হলে যে বড় বড় কাজ হয় তা বলাই বাহুল্য। রাজনীতি অর্থনীতি সমাজ সব মিলিয়ে তারুণ্যের জয়জয়কার হলেই দেশ এগিয়ে চলে। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি আমাদের জানা আছে তারুণ্য কীভাবে শ্রমমুখী আর কর্মনিষ্ঠ হয়। যখন প্রথম এদেশে আসি তখন যৌবন প্রায় নিভু নিভু।

কিন্তু তারুণ্য ছিল মনে। সে তরুণ চোখে যা দেখেছি বা জেনেছি তার মূল্য অপরিসীম। বহু বছর আগে সিডনি এসে প্রথম যে অনুভব তা ছিল দেশ আর মা-বোনসহ বন্ধুদের মিস করা। আর একটা কথা বলতেই হবে, শুধু মানুষ না ঘরের দরজা বন্ধ করে চট্টগ্রামের জন্য কান্নাকাটি করতাম। এই যে মায়া এর নাম দেশপ্রেম কি না জানি না, কিন্তু এই মায়া আমাদের দেশের বড় সম্বল। সম্বল বা ভালোবাসার এই দান আমাদের জনগোষ্ঠীকে মায়ায় বেঁধে রেখেছে। আজকাল সেটা কিছুটা কম বোঝা গেলেও এটাই সত্য।

ছাব্বিশ বছর আগে এক ভোরবেলা এদেশের মাটিতে পা রেখেছিলাম। ট্যাক্সিতে চড়ে যাবার সময় ছবির মতো বাড়িঘর সামনে বাগান সারি সারি বৃক্ষ ও সাজানো রাস্তাঘাট দেখে মনে হচ্ছিল কোনো সিনেমার শূটিং স্পটে এসেছি। টালির ছাউনি, মসৃণ রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যত মানুষ তার তিনগুণ বাড়িঘর।
এরপর কত জল গড়াল। এসেছিলাম অভিবাসন নিয়ে। দু’বছর পর নাগরিক হলাম। জন্মভূমিও ক্যাঙ্গারুর দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকায় সানন্দে তা নিয়েছি। এর সু-দিকটা হলো পৃথিবীর বহু দেশে বিনা ভিসায় ঝামেলামুক্ত ভ্রমণ, নীল পাসপোর্টের খাতির বা সন্দেহের চোখে না তাকানো। কু-দিকও আছে। নাগরিক মানে ভোটার। আর ভোট না দিলে মোটা অংকের ডলার জরিমানা। শুরুতে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি জাতীয় চাকরি পাব।

কঠিন শারীরিক কাজ বা তেমন কিছু পারব না, এটা জানতাম। কয়েক মাসের ভেতরই চাকরি পেলাম ব্যাংকে। দেশের অভিজ্ঞতায় বুক দুরুদুরু করত। ইউনিয়ন যদি বদলি করিয়ে দেয় কালো চামড়া বলে কিংবা বড় সাহেবের বদ নজরে পড়ে যদি কিছু হয়? দেখি পুরো বিপরীত। তারাই বলছে, তুমি কিন্তু এ এলাকার বাইরে কোনো অফিসে যাবে না কোনোদিন।

রিজিওনাল কর্ত্রী এসে চুপটি করে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে কখন হাতের কাজ সেরে তার সঙ্গে দু’মিনিট কথা বলা যাবে। বেশির ভাগ সময়ই তা ছিল সুখবর কিংবা অভিনন্দন জাতীয় আলাপ। একসময় দেখি তারাই জোর করে পদোন্নতি দেয়। মনোজাগতিক দুর্বলতা কাটতে কাটতে একসময় সেবা উপদেষ্টার কাজও করে ফেললাম।

সতেরো বছর পর অর্ধ অবসরে এসে ভাবলাম কিছু তো করা উচিত। অনেকটা যেচেই চাকরি দেওয়া হলো পরীক্ষকের। লেখাপড়া সংশ্লিষ্ট এমন কাজের প্রতি চিরকালের লোভ। তাও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের। সঙ্গে জুটল ইংরেজি পরীক্ষা আয়োজন ও পরীক্ষকের কাজ।
আমার ছেলে এদেশে এসেছিল শিশুকালে।  একদিন স্কুলে না যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করা অর্কের ভয় ছিল ভাষার। পরে সে তাদের ইংরেজি পড়িয়েছে। নিজের ইচ্ছেমতো অভিনয় জগত বেছে নিয়ে এদেশের প্রথম এশিয়ান তরুণ ও বাংলাদেশী হিসেবে হলিউড মুভিতে অভিনয় করেছে। এখানকার প্রধান রাজনৈতিক দল লিবারেল ও লেবর উভয় দলই সম্মান জানিয়েছে তাকে। ২৬ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া ডে উদযাপনেও রয়েছে বিচারকের আসনে। সিডনি শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরি হয়েছে অর্ক।
এই দেশের নামের অর্থ মিলন স্থল। অস্ট্রেলিয়া নামটি এসেছে অ্যাবরিজিনাল বা আদিবাসীদের কাছে থেকে। ৫০ হাজার বছরের বেশি যাদের ইতিহাস বলে দাবি করা হয়, তারা অবশ্য ভাষা লুপ্ত এক জনগোষ্ঠী। তাদের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ইংরেজরা জানত কোন দেশে থাকা যাবে কোন দেশে শাসন করে তারপর ফিরতে হবে। সেভাবেই সেসব দেশকে গড়ে তুলত সাজাত বলে অস্ট্রেলিয়া হয়েছে ইংল্যান্ডের মতো।

এটাও ঠিক তারা এসেছিল আর সেভাবে গড়ে তুলেছে বলেই আমরা সবাই এসেছি। নানা কারণে বসত গেড়েছি। পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট মহাদেশের বড় দেশ। এটাও দেখেছি কথায় না কাজে কতটা মানবিক কতটা উদার দানে। যে পরিমাণ ডলার মানুষ দান করে তা ভাবাও কঠিন। একদিন বেড়াতে এসে এমন এক রেস্তোরাঁয় খেলাম যারা একটি মিল বিক্রি করলে একজন অভুক্ত মানুষের খাবারের টাকা দেয় মুনাফা থেকে।

এ পর্যন্ত ৬ কোটির বেশি মানুষকে খাবার জুগিয়েছে ওরা। যে কোনো কাজে ভলানটিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবক হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষ। নিজের জীবন তুচ্ছ করে কোয়েলা-ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা বুকে নিয়ে ছোটে নারী। এমন মমতা বিরল। আমার মতো ঠোঁটকাটা মন খুলে কথা বলা মানুষের বড় বিপদ।

বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে পদে পদে ভয় ও অপমান। এদেশ তা থেকে মুক্ত রেখেছে আমাকে। এখানেও বাঙালির  নীচতা যায়নি। তবে  তাদের আপনি অনায়াসে এড়িয়ে চলতে পারেন। ‘মেঘেরা যা খুশি লিখে রেখে যাক/আকাশের গায়ে কখনো লাগে না দাগ।’
কোনো তদবির বা যোগাযোগ ছাড়াই আমি পেয়েছি প্রথমবারের মতো আদিবাসী ও বহুজাতিক পদক। কথাগুলো বললাম, কারণ আমাদের দেশের সমাজ ও জীবন যেন গণতন্ত্র বহুজাতিকতা আর সর্বজনীনতা থেকে কিছু শিখতে পারে। এ কথা জোর গলায় বলতে পারি আমরাও পারি। বহু বছর দেশ ছেড়ে এলেও দেশ বা জাতির সঙ্গে আছি, থাকি। তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সাময়িক সব বাধা পেরিয়ে একদিন তারুণ্য এই দেশকে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীকালের সব সংগ্রাম নিয়েই এগোবে।

এখন বাংলাদেশের সামনে নতুন সম্ভাবনার যে হাতছানি তা আগেও এসেছিল। কিন্তু এর ব্যবহার করা হয়নি। একসময় উন্নয়ন আর সংহতিও প্রশ্নবোধক হয়ে যায় যদি জনগণের অংশগ্রহণ না থাকে। গণতন্ত্রই হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। যেসব দেশ বা সমাজকে আমরা গণতন্ত্রের সমাজ বা দেশ বলে জানি, তাদের বাইরে-ভেতরে বহুজন মতবাদ আর সবার জন্য সবকিছুÑএই নিয়ম থাকে। আশা করি, আমরাও সে পথে অগ্রসর হব। সবাইকে অস্ট্রেলিয়া ডের অগ্রিম অভিবাদন।

[email protected]

×