উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ সাইমন জনসন ৮০-এর দশকে বলেছিলেন, ‘যখন কোনো দেশের মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৪ শতাংশ ছেড়ে যায়, তখন সেদেশের অর্থনীতি বলতে কিছু থাকে না’। গত ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রধান সংবাদ ছিল- ‘কমানো যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতি’। সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ আর খাদ্যে ১৫ শতাংশ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের গড় ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। মাথাপিছু গড় ঋণ ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। ঋণগ্রস্ত পরিবার হিসাবে এই অঙ্ক আরও অনেক বেশি। বিশেষ করে শহরের মানুষকে বেশি ঋণ করতে হচ্ছে। ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এই তথ্য প্রকাশ করে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপে সারাদেশের ১৪ হাজার ৪০০ পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালে জাতীয়ভাবে প্রতিটি পরিবারের গড় ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা।
গড়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪.২৬ ধরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০১৬ সালের একই জরিপে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ২৪৩ টাকা। মাথাপিছু ঋণ ছিল ৯ হাজার ১৭৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে প্রতিটি পরিবারের ঋণ বেড়েছে ১১১.১০ শতাংশ। ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ জাতীয় পরিবারের ঋণের প্রায় আড়াই গুণ। ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ এক লাখ ৮৭ হাজার ৩০৮ টাকা। এসব পরিবারের মানুষের গড়ে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ৯৬৯ টাকা।
এদিকে গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলোর ঋণ প্রায় ২১০ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে গ্রাম এলাকায় পরিবারপ্রতি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৪১১ টাকা। যেখানে শহরের পরিবারগুলোর ঋণ গড়ে এক লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৬ টাকা, যা গ্রামের তুলনায় প্রায় তিন গুণের বেশি। যদিও শহরের ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ চার লাখ ১২ হাজার ৬৩৮ টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে শহরে বাস করা পরিবারগুলোর ঋণগ্রস্ত হওয়ার হার বেড়েছে ১৩০.১০ শতাংশ। গ্রামের পরিবারগুলোর ঋণ বেড়েছে ৪১.৭৪ শতাংশ।
২০১৬ সালে গ্রামে পরিবারপ্রতি ঋণ ছিল ৩১ হাজার ৩৩২ টাকা, শহরে ছিল ৫৯ হাজার ৭২৮ টাকা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শহরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বেড়েছে আয়বৈষম্যও। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অধিকাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। অনেক পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে। গ্রামের তুলনায় শহরের দরিদ্র মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বেশি।
‘করোনা মহামারি ও পরবর্তী প্রতিবন্ধকতা কীভাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য, শিক্ষা এবং খাদ্য সুরক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে’Ñ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে।
এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে শহরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ।
সানেম-জিইডি গত ২০১৮ সালে দেশব্যাপী ১০ হাজার ৫০০টি খানায় একটি জরিপ চালায়। এর মধ্যে ৯ হাজার ৬৫টি খানায় গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বরে আবার জরিপ করা হয়। সেই জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। তাদের গবেষণায় বলা হয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ৭০ শতাংশ খানা বা পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে।
পাশাপাশি ৩৫ শতাংশ পরিবার খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কাটছাঁট করেছে। ২৮ শতাংশ ঋণ নিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ সঞ্চয় কমিয়েছে। পরিবারগুলোর ব্যয় বাড়লেও একটি বড় অংশের আয় বাড়েনি অথবা কমেছে।
এর ফলে, অতিদরিদ্র খানার (পরিবার) সদস্যদের মাসিক মাথাপিছু ব্যয় ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছর ২০ শতাংশ কমেছে। শহরের দরিদ্ররা গ্রামের তুলনায় বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গ্রামের ২৯ শতাংশ ও শহরের ৩২ শতাংশ দরিদ্র পরিবার মাঝারিভাবে রয়েছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়। শহরের দরিদ্ররা গ্রামের তুলনায় বেশি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
গ্রামের ২৯ শতাংশ ও শহরের ৩২ শতাংশ দরিদ্র পরিবার মাঝারিভাবে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) নির্দেশিকা অনুযায়ী পরিমাপ করা হয়েছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। এটি ছিল ২০১৮ সালের প্রতিবেদন।
মূল্যস্ফীতিতে ৭০ শতাংশ পরিবারের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনÑ এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ পরিবার মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে, ৩৫ শতাংশ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হ্রাস করেছে, ২৮ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করেছে এবং ১৭ শতাংশ সঞ্চয় হ্রাস করেছে। খাদ্যাভ্যাসের এমন হ্রাসমান তারতম্য পরিবারগুলোকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে ফেলেছে।
দরিদ্র পরিবারের মধ্যে মাঝারি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে ৫ শতাংশ পয়েন্ট (এপ্রিল ২০২৩-এ ২৫ শতাংশ থেকে অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৩-এ ৩০ শতাংশ)। যেখানে গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ৩ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে (৪ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে)।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী পণ্যের বাজারে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে মাস কয়েকের পর স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে। গত প্রায় এক বছর যাবৎ বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যসহ যাবতীয় জিনিসপত্রের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তবে বাংলাদেশে দফায় দফায় দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই।
বাংলাদেশ যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করে থাকে বা করছে, সেগুলোর প্রায় প্রতিটির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। আমদানিকৃত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার দরের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সোজা কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজার দর কমছে, বাংলাদেশে বাড়ছে।
সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি আজকাল মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত। এই নীতির লক্ষ্য হলো সুদের হার বৃদ্ধি করে একটি অর্থনীতির মধ্যে অর্থ সরবরাহ হ্রাস করা। এটি ঋণের খরচ বাড়িয়ে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীর কাছে ঋণকে ব্যয়বহুল করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীর করতে সাহায্য করে। সরকারকে এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়।
এজন্য শিল্পের কাঁচামাল আমদানির পথ অবারিত রাখতে হবে। উৎপাদন খাতে টাকার জোগান বাড়াতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় সব ধরনের বাধা অপসারণ করতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী সন্দেহভাজন বা পলাতক, তাদের বিশেষ তদারকির আওতায় আনতে হবে। যাতে বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়াতে কারসাজি করতে না পারে।
পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হবে। সরকার পণ্যমূল্য কমাতে আমদানি শুল্ক কমাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব নয়। অতীতে এ ধরনের পদক্ষেপ বাজারে কোনো সুফল বয়ে আনেনি। শুল্ক কমানোর সুফল পেতে হলে প্রয়োজন যথাযথভাবে বাজার তদারকি। এ কারণে সরকার বাজার মনিটরিং জোরদারের নির্দেশ দিয়েছে।
তারা বলেন, এখনই শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, যেভাবে পণ্যমূল্য বাড়ছে, তাতে আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে। সরকার এখনই সতর্ক না হলে মার্চে শুরু হওয়া রমজানে বাজার পরিস্থিতি ভোক্তার জন্য পীড়াদায়ক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীসহ মাঝারি ও ছোট কিছু ব্যবসায়ী পলাতক রয়েছেন। তারা বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ বা সরাসরি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যে কারণে গ্রেপ্তারের ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।
তারা পেছন থেকে কোনো ধরনের কলকাঠি নাড়ছেন কিনা, তা জোরালোভাবে মনিটর করার জন্য বিশ্লেষকরা সরকারকে পরামর্শ দেন। বিশ্বে কমলেও বিগত সরকারের ভুল ব্যবস্থাপনায় দেশে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। সে যাই হোক, জরুরি ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে সামাজিক ও অর্থনীতি খাতে চরম বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন