যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে
‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্র্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ -গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান, অনুচ্ছেদ : ১১
বহু আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অমিত সম্ভাবনা নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও, আজও জাতিগতভাবে আমাদের সুদীর্ঘকালের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়নি। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, সামাজিক অনুন্নয়ন এবং সাধারণ জনগণের প্রতি বঞ্চনা আমাদের বিভিন্নমুখী সংকটের আবর্তে জড়িয়ে ফেলছে। যদিও দেশের জনগণের অধিকার রক্ষাকবচ হিসেবে ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-এর ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। কিন্তু বাস্তবে জনগণ কতটুকু ক্ষমতার মালিক হতে পেরেছে বা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে এ বিষয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেশের নাগরিকগণও তাদের মালিকানা সম্পর্কে সচেতন নয়। ফলে, দেশে মূল্যবোধ ও সুশাসনের অভাব ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেশের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি এবং আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদ-। শিষ্টাচার, সততা, আইনের শাসন, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলাবোধ, সরকার ও রাষ্ট্রের কল্যাণমুখিতা, নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সমষ্টিগত রূপই হলো মূল্যবোধ।
মূল্যবোধের প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র হলো পরিবার এবং প্রাতিষ্ঠানিক উৎস হলো শিক্ষালয়। মূল্যবোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক ধারণা হলো সুশাসন। সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সঙ্গে সুশীল সমাজের, সরকারের সঙ্গে শাসিত সমাজের, শাসকের সঙ্গে শাসিতের সম্পর্ক বোঝায়। অর্থাৎ, এ তিনটির মধ্যে বিরাজমান সম্পর্ক কেমন হবে, সেটার রূপরেখা চিত্রায়ন করে সুশাসন। সুশাসনের পূর্বশর্ত হলো গণতন্ত্র।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ কল্যাণমুখী। রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ তৎপর থাকাই কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। যদিও বেশিরভাগ দেশেই তা কেবল কাগজে-কলমেই প্রতীয়মান, বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে শাসক-শাসিতের সুসম্পর্ক, স্বাধীন বিচার বিভাগ, আইনের শাসন, নীতির গণতন্ত্রায়ন, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন মূল্যবোধের চর্চা। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল্যবোধের বিকল্প নেই। যে সমাজ বা রাষ্ট্রে মূল্যবোধ অনুপস্থিত, সেখানে কখনোই সুশাসন প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না।
মূল্যবোধের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মধ্যে নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, দেশের প্রতি, সকল ধর্মের প্রতি সঠিক ও যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। মানুষের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি এবং একটি দেশের সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষের অন্যতম মাপকাঠি হলো মূল্যবোধ। মূল্যবোধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো সামাজিক অবক্ষয় রোধ।
মূল্যবোধ শিক্ষা ব্যক্তিকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে সুশাসনের ভিত্তি মজবুত করে। মূল্যবোধ ও সুশাসন জাতীয় ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার, জাতীয় সংহতি, সমাজের উন্নতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে।
মূল্যবোধ সুশাসনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সুশাসনের সফল বাস্তবায়ন অনেকাংশে সমাজের সদস্যদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার ওপর নির্ভরশীল। মূল্যবোধ ও সুশাসনের প্রভাবে জাতীয় জীবনে সহনশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। সর্বোপরি, বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন মূল্যবোধের শিক্ষা। শিক্ষার সঙ্গে মূল্যবোধ বা জীবনাদর্শের সমন্বয়ে যে শিক্ষার ধারণার উদ্ভব হয় তাই মূল্যবোধের শিক্ষা।
মূল্যবোধ শিক্ষা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সহানুভূতি, সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের ধারণা জাগ্রত করে এবং মানুষের নৈতিকতাবোধের উন্নয়ন ঘটায়। যদি একটি সমাজের মানুষের মধ্যে দুর্নীতি, অসামঞ্জস্য এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞা না থাকে, তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। একইভাবে, সুশাসন মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের বিকাশে সহায়ক হতে পারে। কারণ সঠিক নেতৃত্ব এবং নায্য পরিবেশ মানুষকে ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
রাষ্ট্রে সুশাসনের পূর্বশর্ত সরকারি অঙ্গসংগঠনগুলো থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা। তাই সরকার ও জনগণের সম্মিলিত সহযোগিতায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। শুধু সরকার নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে। মূল্যবোধ এবং সুশাসন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দুটি বিষয় দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, সামাজিক শান্তি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশে মূল্যবোধের প্রভাব সমাজের নৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে এবং জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে। ন্যায়বিচার এবং সামাজিক সাম্য যদি দেশের জনগণ ন্যায় ও সমতাভিত্তিক মূল্যবোধ মেনে চলে, তাহলে সমাজে বৈষম্য, শোষণ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই সহজ হবে। জনসচেতনতা একদিকে যেমন নাগরিকদের অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ, অন্যদিকে সুশাসনের চাবিকাঠিও বটে।
এছাড়া জনগণকে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা এবং সকল উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সুশাসন আরও কার্যকর ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারলে তার রাজনীতি, প্রশাসন এবং অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। আইন সকলের জন্য সমান এবং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এই সুশাসন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আনতে সহায়ক হতে পারে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের পাশাপাশি জনগণের ভূমিকাও অপরিহার্য। মূল্যবোধ এবং সুশাসন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। সুশাসন শুধু কার্যকর হতে পারে যদি জনগণের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ বিদ্যমান থাকে এবং সে অনুযায়ী আইন ও নীতি মেনে চলে। একইভাবে, মূল্যবোধের বিকাশ সুশাসনের মাধ্যমে আরও সহজ হয়, কারণ সুশাসন মানুষের মধ্যে ন্যায়, দায়িত্বশীলতা এবং মানবিকতার চেতনা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
মূল্যবোধ এবং সুশাসনের অভাবে একটি দেশ নানা দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যখন একটি দেশ বা সমাজে সঠিক মূল্যবোধ এবং সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হয়, তখন তার প্রভাব সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং জনগণের জীবনযাত্রার ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
গণতন্ত্রের দুর্বলতা : সুশাসন না থাকলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। নির্বাচন বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক কার্মকা-ে প্রতারণা এবং অনিয়ম ঘটে। যার ফলে জনগণের ভোট এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে। গণতন্ত্রই একটি জাতির মূল চালিকাশক্তি। গণতান্ত্রিক দুর্বলতা কখনোই জাতির জন্য সুফল বয়ে আনে না।
দুর্নীতি বৃদ্ধি : যখন সুশাসন এবং মূল্যবোধের অভাব থাকে, তখন দুর্নীতি শিকড় গেড়ে বসে। সরকারি কর্মকর্তারা স্বার্থপর হয়ে ওঠে এবং তাদের কর্মকা-ে স্বচ্ছতার অভাব দেখা যায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং প্রশাসনে দুর্নীতির কারণে দেশীয় সম্পদের অপচয় হয় এবং জনগণের কাছে পরিষেবা পৌঁছায় না। প্রশাসনিক অব্যস্থাপনা, দুর্নীতি এবং সুশাসনের অভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যার ফলে সরকারি প্রকল্প এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। এর ফলে সার্বিক উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে এবং জনগণের আস্থা কমে যায়।
দরিদ্রতা বৃদ্ধি : দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় দেশের দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেয়। সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং সাহায্য সঠিকভাবে জনগণের কাছে পৌঁছায় না। ফলে সুশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য মৌলিক সুবিধা থেকে জনগণ বঞ্চিত হয়। সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং প্রয়োগ না করলে, একটি জাতি কখনোই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারবে না।
বৈষম্য ও অসাম্য : মূল্যবোধের অভাবের কারণে সমাজে বৈষম্য এবং অন্যায়ের জন্ম হয়। দরিদ্রতা, জাতিগত বা ধর্মীয় বৈষম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এর ফলস্বরূপ সামাজিক অস্থিরতা, গণঅভ্যুত্থান এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে।
সুশাসন ও মূল্যবোধের অভাব, আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয়। বিনিয়োগকারীরা একটি অস্থির, দুর্নীতিপরায়ণ এবং আইনের শাসনহীন পরিবেশে বিনিয়োগ করতে চান না। এর ফলে দেশীয় অর্থনৈতিক সংকট এবং বহু মানুষের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়তে পারে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন : সুশাসনের অভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা পায় না। সরকারের নীতির প্রতি অবহেলা, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং আইনের শাসনের অভাব মানুষকে অধিকার লঙ্ঘনের পথে নিয়ে যায়। এই পরিস্থিতি মানুষের জীবনে নিপীড়ন ও বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। সুশাসনের অভাবে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। জনগণ আইনের প্রতি সম্মান হারিয়ে ফেললে বৃদ্ধি পায় অপরাধমূলক কর্মকা-। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অপরাধীরা আইনের শৃৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আইনের শাসনের অর্থ হচ্ছে সকল নাগরিকের প্রতি আইনের সমান অধিকার। দৃষ্টি অর্থাৎ আইন সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হবে। নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। দেশে সর্বস্তরে আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও দুর্নীতি দূর করা সম্ভব।
আদর্শ সমাজ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য অধিকার কেবল আইনের শাসনের মাধ্যমে বলবৎ করা যায়। আইনের শাসন নিশ্চিত হলে শাসক ও শাসিতের মাঝে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করে। ফলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও জনগণের সেবা প্রদানের কাজটি সহজ হয়। সর্বোপরি কল্যাণকর একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শাসক ও শাসিতের উভয়েরই সমান ভূমিকা বা দায়িত্ব রয়েছে। সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী শাসক রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন আর শাসিত জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে তা মেনে চলবেন।
মূল্যবোধ এবং সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশসহ যেকোনো দেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। দুর্নীতি, আইনের শাসনের অভাব, অপরাধমূলক কর্মকা-, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান অবনতির দিকে চলে যায় এবং দেশের ভবিষ্যৎ শঙ্কার মধ্যে পড়ে। তাই, একটি দেশের সার্বিক কল্যাণ এবং উন্নতির জন্য মূল্যবোধ ও সুশাসন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আমাদের উন্নতিতে ‘মূল্যবোধ ও সুশাসনের অঙ্গীকার’ হলো এমন একটি প্রতিশ্রুতি, যা সমাজের প্রতিটি সদস্যকে নৈতিকতা, সততা এবং দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে উন্নতির পথে চলতে উৎসাহিত করে। উন্নতির প্রক্রিয়া শুধু অর্থনৈতিক বা প্রযুক্তিগত নয়, বরং একটি সংস্কৃতিগত ও মানবিক পরিবর্তনও।
সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং জনগণের প্রতি দায়িত্বের চেতনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু উন্নতির গতি ত্বরান্বিত করে না, বরং সমাজের প্রতি প্রত্যেকের বিশ্বাস এবং আস্থা তৈরি করে। মূল্যবোধ সততা, মানবাধিকার, সহমর্মিতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মতো আমাদের সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারে।
একটি শিশুর প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র হলো তার পরিবার। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কর্তব্য শিশুর সঙ্গে নীতি-নৈতিকতা তথা মূল্যবোধের বীজ বুনে দেওয়া। কেননা নৈতিকতার প্রভাবে মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ থেকে বিরত থাকে এবং রাষ্ট্রের অনুশাসনকে শ্রদ্ধা করে। বিবেক, চিন্তা, বুদ্ধি ও ন্যায়পরায়ণতা হচ্ছে নৈতিকতার উৎস। এই নৈতিকতা বিকাশের লালন ক্ষেত্র হচ্ছে পরিবার তথা সমাজ।
শিশুর জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ, আচরণ এবং ভবিষ্যৎ বিকাশের জন্য পরিবারে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও আদর্শগুলোকে বোঝানো হয়। পরিবার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা এবং সামাজিকীকরণের অন্যতম মূল উৎস। পরিবারে যে নীতি ও মূল্যবোধ গড়ে ওঠে তা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ, তার সামাজিক সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভরশীল, দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যবিরোধী অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য মূল্যবোধ এবং সুশাসন অপরিহার্য। যার মাধ্যমে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি একটি সুশাসন ও সত্যিকারের গণতন্ত্রের দেশ তথা একটি আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে সুপরিচিতি লাভ করবে।
যেখানে বিরাজমান থাকবে জনগণের অংশগ্রহণ, মতামতের নির্ভরশীলতা, দায়বদ্ধতা, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, কার্যকরী ও দক্ষ প্রশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। যার মাধ্যমে একটি ন্যায্য, উন্নত এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে। যেখানে সকল নাগরিক সমান সুযোগ পাবে এবং দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।
লেখক : সেনা কর্মকর্তা