ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইসগুলো চলে ব্যাটারির সাহায্যে। মোবাইল ফোনের ব্যাটারি লিথিয়াম-আয়ন দিয়ে নির্মিত এবং এগুলোর কার্যক্ষমতা সাধারণত ২ থেকে ৩ বছর হয়। এই ধরনের ব্যাটারিগুলোর চার্জিং সাইকেল থাকে ৩০০ থেকে ৫০০ কিন্তু সম্পূর্ণ চার্জ হলে তা অতিরিক্ত গরম হয় এবং বিস্ফোরিত হতে পারে। সেজন্য ১০০ শতাংশ চার্জ যেমন ফোনের জন্য ভালো নয়, তেমনি ব্যাটারি ০ শতাংশ হওয়াও ভালো নয়।
এদিকে লেড এসিড ব্যাটারি বা গাড়িতে ব্যবহৃত ব্যাটারির মেয়াদকাল মোটামুটি ৪-৭ বছর। এই সময়কালের মধ্যে ব্যাটারিতে বিভিন্ন ত্রুটি দেখা দেয়, ফলে ব্যাটারি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। সম্প্রতি মুঠোফোনের জন্য পয়সার চেয়েও ছোট আকারের নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক শক্তির ব্যাটারি তৈরি করেছে চীনের বেটাভোল্ট টেকনোলজি। এটি দৈর্ঘ্যে ১৫ মিলিমিটার, চওড়ায় ১৫ মিলিমিটার এবং পুরুত্ব ৫ মিলিমিটার। একবার চার্জ করে টানা ৫০ বছর চলতে সক্ষম এই ব্যাটারি।
কিন্তু এই সময় কালকেও পেছনে ফেলে বিশ্বে প্রথমবার হীরার মতো দামি পাথর দিয়ে তৈরি হলো এমন এক ব্যাটারি, যা একবার চার্জ করলেই চলবে হাজার বছর। এই অসাধারণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাজ্যের অ্যাটমিক এনার্জি অথরিটি (ইউকেএইএ) এবং ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা। কার্বন-১৪ নামে এক তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে তৈরি এই ব্যাটারিকে বলা হচ্ছে ডায়মন্ড ব্যাটারি।
এটি সৌর প্যানেলের মতো কাজ করে, তবে আলোর পরিবর্তে কার্বন-১৪ এর ক্ষয় থেকে পাওয়া ইলেকট্রনকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে। আরও মজার বিষয় হলো এটি শুধু দীর্ঘস্থায়ী নয়, অত্যন্ত নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব। নির্মাতা প্রকৌশলীদের দাবি এই ব্যাটারি এমন এক যুগান্তকারী শক্তির উৎস, যা হাজার হাজার বছর ধরে ডিভাইসকে শক্তি দিতে সক্ষম। ফলে যেখানে ব্যাটারি পরিবর্তন করা কঠিন বা অসম্ভব এমন সব পরিস্থিতিতে এসব ‘মাইক্রোপাওয়ার’ ধাঁচের ব্যাটারি হবে আদর্শ।
স্মার্টফোন, গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন পেসমেকার, শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র এবং চোখের ইমপ্ল্যান্টে এই ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে। রোগীদের জন্য এটি হবে একটি বিশাল সুবিধা, কারণ একবার ব্যাটারি লাগানোর পর আর বদলানোর প্রয়োজনই হবে না। এছাড়াও আরও নানা ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখছে বিজ্ঞানীরা। যেমন: ১. মহাকাশ গবেষণার জন্যও এটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
চরম পরিবেশে সাধারণ ব্যাটারি যেখানে কাজ করে না, সেখানেও ডায়মন্ড ব্যাটারি কাজ করতে সক্ষম। মহাকাশযান, স্যাটেলাইট এবং পেলোডের মতো ডিভাইসগুলোতে এটি কয়েক দশক ধরে শক্তি সরবরাহ করতে পারবে। কারণ, একবার চার্জ দিয়ে এটি মহাকাশযানে কয়েক শ’ বছর কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম। ২. মহাকাশ অনুসন্ধানের বেলাতেও সহায়ক হতে পারে এসব ব্যাটারি। কারণ ব্যাটারি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন ছাড়াই কয়েক দশক ধরে মহাকাশযান ও বিভিন্ন ট্র্যাকিং ডিভাইসকে শক্তি দেবে নতুন এই ব্যাটারি।
এমনকি এই ব্যাটারি সক্রিয় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (আরএফ) ট্যাগ চালাতে সক্ষম হবে, যা পৃথিবী বা মহাকাশে যন্ত্রাংশ শনাক্ত ও পর্যবেক্ষণ করার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। ৩. চিকিৎসা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পেসমেকার, শ্রবণ সহায়ক ও চোখের ইমপ্লান্টের মতো ডিভাইসে ব্যবহার হতে পারে এসব ব্যাটারি। প্রচলিত ব্যাটারির বদলে হীরার তৈরি এসব ব্যাটারি রোগীদের আয়ু দীর্ঘায়িত করতে পারে। এসব ব্যাটারির ফলে মানুষের বারবার অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন কমে আসবে এবং রোগীরাও আরামবোধ করবেন।
৪. পৃথিবীতেও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে ব্যবহার করা যেতে পারে এসব ব্যাটারিকে। যেমন- গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান বা কোনো দূরবর্তী স্থান, যেখানে মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত রয়েছে এমন সব জায়গায়। ৫. ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের অধ্যাপক টম স্কট বলেছেন, ‘মেডিকেল ইমপ্লান্ট থেকে শুরু করে মহাকাশ ব্যবস্থা পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে শক্তি সরবরাহ করতে পারবে এসব ব্যাটারি, শিল্প ও গবেষণা খাতে কাজ করছেন এমন আগ্রহীদের সঙ্গে এই হীরার ব্যাটারির বিভিন্ন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে আগ্রহী।’
হীরার তৈরি ব্যাটারির এই দীর্ঘ আয়ুর চাবিকাঠি হচ্ছে কার্বন-১৪। কার্বনের এই তেজস্ক্রিয় পদার্থটির ‘হাফ লাইফ’ পাঁচ হাজার ৭শ’ বছর। এক চার্জে ৫ হাজার বছর চলার সক্ষমতা শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবনই নয়, মহাকাশ ও চিকিৎসা খাতেও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দেবে। এটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব শক্তি-উৎসের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। গবেষকরা বলছেন, হীরার তৈরি এই ব্যাটারিতে শক্তি সঞ্চয়ে বিপ্লব ঘটাতে পারে কার্বন-১৪। তবে, এর দাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
হীরার মতো ব্যাটারির মূল্য সাধারণ মানুষের জন্য কতটা সাশ্রয়ী হবে, সেটি নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে এর উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নত হলে খরচ কমে আসবে। এই ব্যাটারির প্রযুক্তি আরও একটি বিশেষ দিক তুলে ধরে এটি পরিবেশবান্ধব। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ হলেও, কার্বন-১৪ এর ক্ষুদ্র পরিমাণ কৃত্রিম হীরায় সুরক্ষিতভাবে স্থাপন করা হয়।
তাই এটি ব্যবহারে কোনো ঝুঁকি নেই। গবেষকদের মতে, এই ব্যাটারি শুধু শক্তি খাতে নয়, প্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এটি এমন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, যা ভবিষ্যতের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান দেবে।
কার্বন-১৪ হলো কার্বনের তেজস্ক্রিয় রূপভেদ। এই কার্বন-১৪ দিয়ে কোনো বিশেষ প্রকারের তেজস্ক্রিয় কার্বন কোনো বস্তু কতটুকু ধারণ করেছে, তার ভিত্তিতে প্রতœবস্তুর বয়স নির্ধারণ করা যায়। কার্বন-১৪ বা রেডিওকার্বন হল কার্বনের একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ যার একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়াস রয়েছে, যার মধ্যে ৬টি প্রোটন এবং ৮টি নিউট্রন থাকে।
পৃথিবীতে তিনটি প্রাকৃতিকভাবে কার্বনের আইসোটোপ রয়েছে: কার্বন-১২, যা পৃথিবীর সমস্ত কার্বনের ৯৯% তৈরি করে; কার্বন-১৩, যা ১% তৈরি করে; এবং কার্বন-১৪, যা ট্রেস পরিমাণে ঘটে, যা বায়ুম-লে কার্বনের প্রতি ১০১২টি পরমাণুতে প্রায় ১-১.৫ পরমাণু তৈরি করে। কার্বন-১২ এবং কার্বন-১৩ উভয়ই স্থিতিশীল কিন্তু কার্বন-১৪ অস্থির, অর্ধ-জীবন ৫৭০০ক্ট৩০ বছর। কার্বন-১৪ ক্ষয় হয় নাইট্রোজেন-১৪ (১৪ এন) বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে। প্রতি ১০১২ পরমাণুতে কার্বন- ১৪ এর ১ পরমাণু ধারণকারী এক গ্রাম কার্বন, প্রতি সেকেন্ডে ০১.২[৭] বিটা (ব্জ) কণা নির্গত করে।
পৃথিবীতে কার্বন-১৪ এর প্রাথমিক প্রাকৃতিক উৎস হলো বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেনের ওপর মহাজাগতিক রশ্মির ক্রিয়া। অর্থাৎ এটি একটি মহাজাগতিক নিউক্লাইড। ১৯৪০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া রেডিয়েশন ল্যাবরেটরিতে মার্টিন কামেন এবং স্যাম রুবেন দ্বারা কার্বন-১৪ আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে ১৯৩৪ সালে ফ্রাঞ্জ কুরি এর অস্তিত্বের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে উইলার্ড লিবি নামের এক মার্কিন বিজ্ঞানী প্রথম আবিষ্কার করেন যে জৈব বস্তুসামগ্রী, যেমন কাঠ, কাঠকয়লা, হাড়, অতসী, শিং এবং পীট ইত্যাদি বস্তুগুলো একসময় কোনো না কোনো প্রাণসত্তার অংশ ছিল, যা প্রকৃতি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন-১৪ গ্রহণ করে থাকে। সেজন্য আজকাল কার্বন-১৪ পদ্ধতির বহুল ব্যবহার হয়ে থাকে প্রতœতত্ত্বে। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে জীবিত গাছপালা বায়ুম-ল থেকে প্রায় সমপরিমাণ তেজস্ক্রিয় কার্বন-১৪ এবং অতেজস্ক্রিয় কার্বন কার্বন-১২ শোষণ করে, আর যেসব প্রাণী এই উদ্ভিজ্জাত খাদ্য গ্রহণ করে তারাও এই দুই প্রকার কার্বন গ্রহণ করে।
মৃত্যু হয়ে গেলে প্রাণী আর কার্বন শোষণ করতে পারে না। শোষিত সেই কার্বন-১৪ তেজস্ক্রিয়া ক্ষয়ের মাধ্যমে শক্তি তৈরি করে ব্যাটারির কাজ করে ষ এই উদ্ভাবন আংশিকভাবে ইউকেএইএ’র ফিউশন এনার্জি নিয়ে গবেষণার ফল। গবেষকরা আশা করছেন, এই হীরার ব্যাটারি শক্তি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে এবং ভবিষ্যতে অনেক নতুন প্রযুক্তির জন্য পথপ্রদর্শক হবে, যা কেবল কয়েক বছর নয়, শতাব্দী ধরে চলবে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়