ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

ইউথেনেসিয়া \ মৃত্যুর ভিন্ন রুপ

মো. আরমান হোসেন

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২১ জানুয়ারি ২০২৫

ইউথেনেসিয়া \ মৃত্যুর ভিন্ন রুপ

গত বছরের ২৯ নভেম্বরে ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা দিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ হাউস অব কমন্সে একটি বিল প্রাথমিকভাবে অনুমোদন পেয়েছে।ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই বিলটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৩৩০ জন আইনপ্রণেতা এবং বিলটির  বিপক্ষে ভোট দেন ২৭৫ জন আইনপ্রণেতা।প্রস্তাবিত এই বিলটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসে চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে এবং তা আইনে পরিণত হলে গুরুত্বর অসুস্থ রোগীরা সেচ্ছায় মৃত্যু গ্রহণ করতে পারবেন।বিলটির গঠনপ্রণালীতে বলা হয় যদি কোনো ব্যক্তি গুরুতর কোনো রোগে আক্রান্ত হয় এবং রোগীর চিকিৎসক কর্তৃক ঘোষণা  আসে যে রোগী ছয়মাস বা তারও কম সময় বেঁচে থাকবেন এমন পরিস্থিতিতে রোগী চাইলে ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করতে পারবেন। তবে এখানে শর্ত হিসেবে রোগীর শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই বিলটি নিয়ে বিপক্ষ দলের  আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে  জোরালোভাবে বিতর্ক শুরু হয়। ফলে  ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু' বিষয়টি  ¤প্রতি  বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।

সা¤প্রতিক সময়ে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান  অনুযায়ী কানাডায়  ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে মৃত্যু বেড়েছে। যদিও ২০১৬ সালেই দেশটিতে  ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা প্রদান করা হয়েছে। কানাডায় প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজন মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করছে।২০২৩ সালে দেশটিতে প্রায় ১৫ হাজার ৩০০ জন ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে যা কানাডার মোট মৃত্যুর দশমিক শতাংশ। দেশটিকে ২০২৭ সালের মধ্যে মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রেও ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু কার্যকর হতে চলেছে।

এদিকে বাংলাদেশেও ২০১৭ সালে মেহেরপুরের একজন ফলবিক্রেতা  তার দুই ছেলে এবং নাতির জন্য ইউথেনেসিয়ার জন্য  হাইকোর্টে আবেদন করেন যা নিয়ে নতুন করে একটি তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়।তার দুই ছেলে এবং নাতি  মাস্কুলার ডিস্ট্রফিতে আক্রান্ত যার কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি বের হয় নি। অবস্থায় ফল বিক্রেতা সহায় সম্বল সব হারিয়ে ইউথেনেসিয়ার জন্য হাইকোর্টের দারস্থ হন যদিও পরবর্তীতে তার এই আবেদন বাতিল  করে দেন আদালত।

সা¤প্রতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু একটি জনপ্রিয় মৃত্যুর মাধ্যম হিসেবে বর্তমান সময়ে কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। ইউথেনেসিয়া শব্দটি গ্রিক শব্দ 'ইউ' যার অর্থ 'ভালো' বা 'সহজ' এবং 'থানাতোস' মানে 'মৃত্যু' থেকে এসেছে।শাব্দিক অর্থে ইউথেনেসিয়া মানে হলো যন্ত্রণাহীন মৃত্যু বা  সহজ মৃত্যু। ইউথেনেসিয়া বলতে দুরারোগ্য রোগের কারণে দীর্ঘস্থায়ী বেদনা কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রোগী বা রোগীর আত্মীয়স্বজনদের ইচ্ছায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহজে মৃত্যু কার্যকর করাকে বুঝায়।এটি রোগীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছা,সম্মতি বা অসম্মতি উভয় ভাবে কার্যকর হতে পারে।

আধুনিককালে কয়েক রকমের ইউথেনেসিয়া কার্যকর হতে দেখা যায়।তবে তার মধ্যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ  ইউথেনেসিয়া বা ইচ্ছামৃত্যু সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। প্রত্যক্ষ ইউথেনেসিয়ায় মৃত্যু কার্যকর করার নিমিত্তে বিভিন্ন প্রাণঘাতী পদার্থ ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ উচ্চ মাত্রার ক্ষতিকর ইনজেকশন বা অন্য কোনো বিষাক্ত মেডিসিন প্রয়োগের মাধ্যমে পদ্ধতিতে মৃত্যু কার্যকর করা হয়।আবার পরোক্ষ ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে রোগীকে প্রাণঘাতী রোগ থেকে বাঁচানোর জন্য যেসব জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা থেকে বিরত থাকা অর্থাৎ রোগী যদি অক্সিজেনের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন রোগীর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করার জন্য সেই বেঁচে থাকার মাধ্যম বা অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয় তখন তা পরোক্ষ ইউথেনেসিয়ার মধ্যে পড়ে। বিশেষত ২০১৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে পরোক্ষ বা প্যাসিভ ইউথেনেসিয়াকে বৈধতা প্রদান করে।একইসাথে ইউথেনেসিয়া সম্পর্কিত অনেক আইনি শর্ত এবং সীমাবদ্ধতাও ঘোষণা করে যাতে কেউ ভুলভাবে ইউথেনেসিয়াকে ব্যবহার করতে না পারে।

অনেকেই ইউথেনেসিয়া এবং আতœহত্যাকে একই দৃষ্টিতে  দেখেন আসলে যা মোটেও এক বিষয় নয়। দু'টি মূলত ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তু। কোনো ব্যক্তি আর্থিক, সামাজিক চাপ,পারিবারিক সমস্যা এবং মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়াই হলো আতœহত্যা।আতœহত্যা অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে হয়ে থাকে। যেখানে প্রায় সকল রাষ্ট্র- আতœহত্যাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এবং প্রায় সকল ধর্মই আতœহত্যাকে মহাপাপ হিসেবে দেখে।অন্যদিকে ইউথেনেসিয়া হলো এমন একটি মৃত্যুর পদ্ধতি যেখানে কোনো ব্যক্তি নিরাময় অযোগ্য কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে তাকে অসহনীয় কষ্ট বা ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য প্রাণনাশে সহায়তা করা যা রোগীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার মাধ্যমে ঘটানো হয়ে থাকে।ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে রোগী বা রোগীর আত্মীয়স্বজনের স্বাধীন ইচ্ছাকে কার্যকর করার জন্য কিছু নিয়ম বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।অর্থাৎ এখানে মৃত্যুর ইচ্ছার সপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দিতে হয়। ইউথেনেসিয়া এবং আতœহত্যা উভয়ই বিপরীতমুখী যা কখনো এক বিষয় নয়।

এদিকে যেমন ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে মৃত্যু জনপ্রিয় হচ্ছে তেমনই ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে মৃত্যু নিয়ে বিতর্কও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ এই বিষয় নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের বিভিন্ন ধরণের যুক্তি-তর্ক রয়েছে।ধর্ম, নৈতিকতা,রাষ্ট্র, আইন এবং বাস্তবতার নিরিখে অনেকেই  ইউথেনেসিয়ার বিপক্ষে অবস্থান করে।ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে কোনোভাবেই মৃত্যু গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ধর্মমতে মানুষের জীবনের কার্যতঃ মূল্য রয়েছে যেখানে ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে মৃত্যু গ্রহণ করলে সরাসরি সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে অবস্থান করা বুঝায়  এবং তা সৃষ্টিকর্তার স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী। কারণ ইসলামসহ প্রায় সকল ধর্মেই ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে মৃত্যু গ্রহণ নিষিদ্ধ। এখন প্রশ্ন আসতে পারে ধর্মীয় বিধিবিধান থাকার পরও মানুষ কেনো ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিচ্ছে? এর উত্তর দেয়া খুব কঠিন কোনো বিষয় নয়। কারণ  যখন মানুষ বিভিন্ন  মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত হয় তখন জীবন মানুষের কাছে শত্রæ হয়ে দাঁড়ায়। সেসময়ে রোগীর কাছে জীবনের অন্তর্নিহিত মূল্য মলিন হয়ে যায়।  যার ফলে রোগীর কাছে বেঁচে থাকা এক নিদারুণ যন্ত্রণা বোঝা হয়ে যায়। ফলে অনেক রোগী স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য্য থাকে না। ফলশ্রুতিতে রোগীরা ইউথেনেসিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুর পথ গ্রহণ করে।নৈতিকতার বিষয়টি ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেও বর্তমান সময়ে ইউথেনেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু ধীরে ধীরে একটি জনপ্রিয় মৃত্যুর মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বে ইউথেনেসিয়া যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার প্রভাব ভবিষ্যতে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।

 

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

×