অবাধ তথ্যপ্রবাহ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় গণমাধ্যমের হাত ধরে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সেই যাত্রা বর্তমানে আরও বেগবান। চোখের পলকে দুনিয়ার তাবৎ তথ্য মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সচেতনতা। কোনো তথ্য পেলেই মানুষ অন্ধের মতো বিশ্বাস করে না। যাচাই করে নেয় সত্যাসত্য। গণমাধ্যমে সংবাদকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিধিনিষেধের অনুসরণ করা হয় না। অনেক সময় শিক্ষাগত যোগ্যতাও দেখা হয় হাল্কা করে। ইদানীং গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন নয় এমন প্রার্থীকেও প্রতিবেদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো হাউসে সম্পাদক বা হেড অব নিউজের পরিচিত হলে নিয়োগ পাওয়া যায়। আবার ভিজুয়াল মাধ্যম টেলিভিশন সাংবাদিকতায় জেলা ও মহানগরী পর্যায়ে একাধিক প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে লোগো বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ থেকে শুরু করে হেড অব নিউজ কিংবা সম্পাদকের বিরুদ্ধে। টেলিভিশনের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি কিংবা মালিকের সুনজরপ্রাপ্ত ব্যক্তি অযোগ্য হলেও খুব সহজে সাংবাদিক হয়ে যায়।
কোনো ধরনের প্রাথমিক ও মৌলিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই রিপোর্টারদের ছেড়ে দেওয়া হয় মাঠে। যার ফলে সাংবাদিকতার মতো একটি দায়িত্বশীল পেশায় অপসাংবাদিকতার বিস্তার ঘটছে। বাংলা ভাষা ও উচ্চারণের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় নিউজ লেখা ও সম্পাদনায় যেমন ভুল থাকে, তেমনি ক্যামেরার সামনে লাইভেও অবাঞ্ছিত শব্দ চয়ন ও উচ্চারণ করতে দেখা যায়। এতে ভাষা দূষণের পাশাপাশি টিভি চ্যানেলের বদনামও হচ্ছে। যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে একজন রিপোর্টার উপযুক্ত প্রশ্ন করতে ব্যর্থ হন।
উদ্বেগের বিষয়, প্রতিষ্ঠিত টিভি চ্যানেলগুলোতে শিক্ষানবিস সাব-এডিটর নিয়োগ দেওয়া হয়, কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। সম্পাদনার ঘাটতির ফলে ছোট ছোট সংবাদেও মোটা দাগে ভুল ধরা পড়ে। শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আইনজীবীর মতো সাংবাদিকতাও একটি মহান পেশা। এ পেশাগুলোয় শুধু ডিগ্রি থাকলেই হয় না, পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কাউন্সিল থেকে পরীক্ষা দিয়ে সনদ গ্রহণ করতে হয়। যদিও সাংবাদিকতা একটি সৃজনশীল পেশা, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো সনদ ব্যবস্থা না থাকায় প্রচুর অপসাংবাদিক প্রবেশ করে এ পেশার ঐতিহ্য নষ্ট করছে। তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সাংবাদিকদের জন্য একটি সেন্ট্রাল ডেটাবেজ তৈরি করা অতিব প্রয়োজন। গণমাধ্যম কর্মীদের সচিবালয়ে প্রবেশ কার্ড প্রদানে সত্যিকারের সাংবাদিক নিশ্চিত হওয়া উচিত। এ জন্য অ্যাক্রিডিটেশন নীতিমালা আপডেট করা প্রয়োজন।
মূলধারা ও আন্ডার গ্রাউন্ড গণমাধ্যমের সংজ্ঞায়ন করা আবশ্যক। পেশার মান ধরে রাখতে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও সনদ ব্যবস্থা চালু করা উচিত। চালুর সিদ্ধান্ত হলে যারা চাকরিরত তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নিরীক্ষণের মাধ্যমে সনদ দেওয়া আবশ্যক। যারা নতুন প্রবেশ করবে তাদের সনদ নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করতে হবে। আধুনিক ভিজুয়াল মাধ্যম টেলিভিশনে বেতন-ভাতা সংক্রান্ত কোনো ওয়েজ বোর্ড নেই। সংবাদপত্রে ওয়েজ বোর্ড থাকলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে তা অনুসরণ করা হয় না। কর্মীর নিয়োগপত্রে ওয়েজ বোর্ড ফলো করার যে তথ্য থাকে, তা বেশিরভাগ হাউজেই শুভঙ্করের ফাঁকি। অনেকেই জীবিকার তাগিদে মাত্র ১০/১৫ হাজার টাকায় শিক্ষানবিস সাংবাদিক হিসেবে কাজে যোগদান করে। নিয়োগপত্রে বলা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে হয় না। আবার ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রেও দ্বিচারিতা দৃশ্যমান। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট দেওয়া আবশ্যক। কর্মাভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদন্নোতি নিশ্চিত করা উচিত। এ জন্য একটি গণমাধ্যমবান্ধব চাকরির বিধিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। দুনিয়ার সর্বত্র শ্রমসময় ৮ ঘণ্টা হলেও গণমাধ্যমে এটা মানা হয় না বা মানা যায় না। ঢাকায় অবস্থানরত গণমাধ্যম ভবনগুলোর বেশিরভাগই নিরাপদ নয়। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা অপ্রতুল। এ বিষয়ে মালিক পক্ষের অনীহা চোখে পড়ার মতো। অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে পুরনো ভবনে। যে কোনো সময় ধসে যেতে পারে।
একজন সংবাদকর্মী যখন কোনো দুর্ঘটনা কাভার করতে যায় তখন হাউজগুলো ন্যূনতম ঝুঁকি নিরসন সরঞ্জাম বিতরণ করে না। হাল আমলে চেস্টশিল্ট ও হেলমেট দেওয়া হচ্ছে, তবে মাঠে কাজ করতে বেগ পেতে হয়। লেটনাইট ডিউটির ক্ষেত্রে বাসায় পৌঁছানোর জন্য অনেক হাউজই যানবাহনের ব্যবস্থা রাখে না। গভীর রাতে ছিনতাই কিংবা দুর্বৃত্তের হামলার সমূহ ঝুঁকি থাকে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন নারী কর্মীগণ। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বিভাগ, দেশী-বিদেশী এনজিওর প্রত্যক্ষ সহায়তায় একটি নিরাপত্তা ম্যানুয়াল তৈরির করা যেতে পারে।
গণমাধ্যমের অভ্যন্তরে নারীবান্ধব অনুকূল পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে যৌন হয়রানি নিরসনে প্রতিটি হাউজে কমিটি গঠন করা দরকার। ইদানীং যৌন হয়রানির কথা প্রকাশ্যে আসছে। ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ সাংবাদিক সংগঠনগুলো প্রকৃত সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব করছে না। সদস্যদের সিংহভাগই মূল ধারার সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত নয়। অথচ সরকার যখন সাংবাদিকদের বিষয়ে কথা বলতে চায়, তখন এসব ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গেই বৈঠক করে। ফলে সাংবাদিকদের প্রকৃত সমস্যা সরকারের কাছে পৌঁছায় না। তাই সমাধানও হয় না।
কোনো সংবাদ নিয়ে কারও আপত্তি থাকলে আদালতে না গিয়ে প্রথমে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ জানাতে আইনি সংশোধন আনা দরকার। ধান্ধাবাজি, চাঁদাবাজি, অপসাংবাদিকতার জন্য শাস্তির বিধান ও জরিমানার ব্যবস্থা করা উচিত। প্রেস কাউন্সিলকে আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার আলোকে ঢেলে সাজানো দরকার। এতে সংবাদ সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা অনেক কমে যাবে। সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর সদস্য ও নেতৃত্বে যাতে নিবন্ধিত গণমাধ্যম কর্মীরা আসতে পারেন, তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সংবাদবিট ভিত্তিক সংগঠনগুলোর নেতৃবর্গীয়দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গণমাধ্যম সংস্কারে সুপারিশ করা আবশ্যক। এতে প্রকৃত মাঠের সাংবাদিকদের অভিমত জানা যাবে। যে কোনো ধরনের সমস্যার ত্বরিত সমাধান হবে।
বাংলাদেশে কতজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী আছেন তার হিসাব আছে সরকারের কাছে। কিন্তু কতজন সাংবাদিক আছেন তার কোনো সঠিক তালিকা নেই। ফলে ভুয়া সাংবাদিক নাগরিকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চাঁদাবাজি করছে। মূলধারা ও আন্ডারগ্রাউন্ড গণমাধ্যমের কথা সব সময় আলোচনায় আসে। কিন্তু এর কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। এতে করে, অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড গণমাধ্যম মূল ধারার লোগো কপি করে জনগণকে ভুয়া তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে। অবাধ তথ্যপ্রযুত্তির কল্যাণে ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়েছে। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ডিজিটাল মিডিয়া। দেশী-বিদেশী সংবাদভিত্তিক মিডিয়ার ছড়াছড়ি। এসব অনলাইনভিত্তিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান অনেক সময় ভুল, অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রচার করে সমাজ ও রাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরি করছে। সাংবাদিকতা পেশাকে যদি একটি সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা যায় তবে গণমাধ্যম কর্মীদের পেশাদারিত্বে দক্ষতা বাড়বে এবং চাকরির নিশ্চয়তার পাশাপাশি বাড়বে প্রতিষ্ঠানের আয়। সৎসাংবাদিকতার প্রসার ঘটবে। মেধাবী তরুণ প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল ছেলেমেয়েরা এ পেশায় আসতে আগ্রহ বোধ করবে।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে গণমাধ্যম, যা গণতন্ত্র প্রসারে সহায়তা করবে। গণমাধ্যমের জন্য গণশত্রু সেই আদিকাল থেকেই তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে বিরাজমান। গণমাধ্যমের মতো স্পর্শকাতর এই অঙ্গনের মুক্তবিহঙ্গ পরিচিতি আসলে কেউই দিতে চায়নি কোনোকালে! তবু আমরা আশাবাদী এবার কিছু একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে আগামীর সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে।
লেখক : সাংবাদিক
গণমাধ্যম সংস্কারে কিছু প্রস্তাব
শীর্ষ সংবাদ: