মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষ তার চিন্তা ও নব নব উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল নৈতিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার অভাবে আধুনিক এই সভ্যতা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি জায়গায়, সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অস্ত্রের ঝনঝনানি, ক্ষমতার লড়াই, মানুষে মানুষে হানাহানি, যুদ্ধ বিগ্রহ, গুম, খুন, দুর্নীতি, ধর্ষণ, হত্যা, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, নারী ও শিশু নির্যাতন, সাইবার ক্রাইম ইত্যাদি অপরাধ নিয়মিত সংঘটিত হচ্ছে। অশ্লীলতা আর মাদকসেবনকে যেভাবে স্বাভাবিকতা দেওয়া হচ্ছে যেন এগুলো কোন অপরাধই নয়।
আমাদের মাতৃভ‚মি বাংলাদেশও কোনদিক থেকে পিছিয়ে নেই। জাতি হিসেবে আমরা আদর্শবান জাতি হতে পারিনি। ফলে দূর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। ঘুষ, উৎখোচ, লুটপাট, খুন,ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। গ্রাম থেকে শহর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই অশ্লীলতা মাদকদ্রব্য আর অপরাধ প্রবণতার ছড়াছড়ি। দেশের বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করেও অপরাধ প্রবনতা কমানো যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়নকারী প্রশাসন নিজেই দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে এখন শুধু আইনের প্রয়োগ নয় পাশাপাশি নৈতিকতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা অপরিহার্য।
মানব আচরণ পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণের যে সকল মানদÐ বা আদর্শ রয়েছে তার মাঝে অন্যতম হল নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। এটিকে বলা হয় আচরণের অলিখিত দলিল। শিক্ষা যেমন জাতিকে আলোকিত করে তেমনি নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ একটি জাতিকে সুশৃঙ্খল ন্যায়পূর্ণ দায়িত্বশীল মর্যাদাবান করে তোলে। জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সুস্থিতির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। এটি মানুষের চিন্তা, আচরণ ও কর্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। একটি জাতি তখনই উন্নত ও মর্যাদাশীল হয়ে ওঠে, যখন সে জাতির নাগরিকদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সুদৃঢ় হয়।
নৈতিকতা বলতে সাধারণভাবে সত্য, ন্যায়, আদর্শ, সততা, সহানুভ‚তি, মানবিকতা, পরোপকারিতা, দায়িত্ববোধ ইত্যাদিকে বোঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, ভালো মন্দের বিচার করার মানদন্ডই হলো নৈতিকতা। এটি মানুষের আচরণকে শুদ্ধ ও সুন্দর করার শিক্ষা দেয়। নৈতিকতার অভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, অন্যায় ও অপরাধের বিস্তার ঘটে। মানুষের আচরণ পরিকল্পনাকারী নীতি ও মানদÐ হলো মূল্যবোধ। হিন্দু, মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান প্রতিটি ধর্মই ন্যায়, সত্য ও মানবিকতার শিক্ষা দেয়। বিশেষ করে ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষকে আত্মশুদ্ধি, সংযম ও পরোপকারিতার পথে পরিচালিত করে।
আদর্শ জাতি গঠনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভ‚মিকা
সততা ও ন্যায়ের চর্চা: নৈতিকতা ও মূল্যবোধ মানুষকে সত্যবাদিতা, সততা ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। একজন নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি কখনো অন্যায়, প্রতারণা বা দুর্নীতিতে লিপ্ত হবে না।
দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা: আদর্শ জাতি গঠনে নাগরিকদের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকতা মানুষকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।
সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ: ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষকে পারস্পরিক সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। এতে সমাজে বিভেদ, বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার সুযোগ কমে যায়।
শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন: নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের চারিত্রিক গঠন ও নৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে।
সামাজিক সুবিচার ও সমতা: নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সমাজে সুবিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে।
আদর্শ জাতি গঠনে করণীয়
শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্তি: শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি যতই শিক্ষিত হোক না কেন যদি তার মধ্যে সঠিক ধর্মীয় মূল্যবোধ না থাকে তাহলে তার মধ্যে মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনা।
অধ্যাপক বার্বাস ঞযব চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ঃযব গড়ফবৎহ ঊফঁপধঃরড়হ গ্রন্থে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন না করলে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
পরিবারে নৈতিক শিক্ষার চর্চা: পরিবার হলো শিশুর নৈতিক শিক্ষার প্রথম বিদ্যালয়। বাবা-মা ও অভিভাবকদের উচিত শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সত্যবাদিতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দেওয়া।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভ‚মিকা: মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডা থেকে নৈতিকতা ও মানবিকতার বাণী বেশি বেশি প্রচার করা উচিত।
গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভ‚মিকা: গণমাধ্যম নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সকল প্রকার সামাজিক সাংস্কৃতিক দ্ব›দ্ব সংঘাত থেকে দূরে রাখতে কার্যকরী ভ‚মিকা রাখে। এটির চর্চা ছাড়া কোনো জাতি সত্যিকারের উন্নত ও মর্যাদাবান হতে পারে না। এজন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলেই আমরা একটি আদর্শ জাতি গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়