ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

অসৎ রাজনীতিতে গণতন্ত্রের পতন

শেখ আশরাফুজ্জামান

প্রকাশিত: ২০:২০, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

অসৎ রাজনীতিতে গণতন্ত্রের পতন

রাজনীতিবিদ সাধারণত রাজনৈতিক তত্ত্ব, নীতি এবং জনগণের কল্যাণের প্রতি গুরুত্ব দেন। তাদের লক্ষ্য সাধারণত সমাজের উন্নতি এবং মানুষের মঙ্গলার্থে কাজ করা। রাজনীতিবিদের অসততা এবং দুষ্টু চরিত্র একটা রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থাকে কেমন চরম পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে সেটা আমরা এখন ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে পারি। রাজনীতিবিদ যদি সৎ না হন তার সঙ্গে সমাজের অন্যান্য অসৎ চরিত্রের সুবিধাভোগী সমাজ গঠনকারী মিলে যায়। তখন  রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী,  সন্ত্রাসী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজ যারা মূলত দেশ তথা রাষ্ট্র সমাজ কে চালায় সবাই মিলেমিশে এক হয়ে দুর্নীতি করতে থাকেন। যেমন ধরুন ঢাকা ওয়াসার পানির লাইন আর স্যুয়ারেজের লাইন কোনো কারণে এক হয়ে গেলে কি হবে? গোসল করতে গিয়ে বাথরুমের সাওয়ার ছাড়লে মাথায় ময়লা  পানি পড়বে। রাজনীবিদরাই কিন্তু রাষ্ট্র চালায়, রাষ্ট্রকে রাজনীতিবিদরাই বেশি ভালোবাসেন, দেশপ্রেম, দেশের প্রতি  ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি থাকে রাজনীতিবিদের ভেতরে। আর সেই রাজনীতিবিদরা যদি চরিত্রহীন হন তখন সমাজের যারা কর্ণধার, সমাজকে যারা চালায় সবাই তখন মিলেমিশে  দুর্নীতিতে শামিল হয়। রাজনীতিবিদগণ  অসৎ চরিত্রের হলে  রাষ্ট্র এবং সমাজের  ওপর যে  আঘাত আসে  আমাদের ক্ষুদ্র চিন্তায় তার একটি খণ্ডিত চিত্র কেমন হতে পারে তার সংক্ষিপ্ত  রূপ বর্ণনা করা যেতে পারেÑ          
গণতন্ত্রের পতন : গণতন্ত্রকে প্রায়ই শাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী পদ্ধতি হিসেবে মনে করা হয়, যা সমতা, ন্যায়বিচার এবং জনগণের অংশগ্রহণের মূলনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। এটি নাগরিকদের তাদের নেতাদের নির্বাচিত করার এবং সমাজ গঠনের ক্ষমতা প্রদান করে। তবে, ইতিহাসের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এমনকি সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলো থেকেও পতন ঘটতে পারে এবং এই পতনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর কারণ হিসেবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের অসৎ চরিত্রকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। যখন রাজনীতিকরা তাদের ওপর প্রত্যাশিত নৈতিক মান থেকে বিচ্যুত হন, তখন তারা শুধু নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই নষ্ট করেন না, বরং গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন।
রাজনীতিকদের নৈতিক অখণ্ডতা : একটি কার্যকর গণতন্ত্রের মূল হচ্ছে নেতাদের সততা। রাজনীতিকরা জনগণের স্বার্থে কাজ করার, সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য নীতিমালা তৈরি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত হন।  যখন রাজনীতিকরা এই প্রত্যাশাগুলো পূর্ণ করতে ব্যর্থ হন এবং অসততা, দুর্নীতি, প্রতারণা এবং লোভের মতো বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেন, তখন তারা সেই ব্যবস্থা বিপন্ন করে তোলেন, যা জনগণের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে। রাজনীতিকদের চরিত্র গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একাধিকবার মীমাংসাকারী হতে পারে। যখন ক্ষমতাসীনরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য জনগণের কল্যাণের চিন্তাকে অগ্রাধিকার দেন, তখন তারা গণতন্ত্রের মূল মানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। অসৎ চরিত্রের এক রাজনীতিক সাধারণত ঘুষ, প্রভাবশালী আত্মীয়তার সুযোগ নেওয়া এবং অযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো কাজ করতে পারেন, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এবং জনগণের মধ্যে অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করে।
বিশ্বাসের ক্ষয় : রাজনীতিকদের নেতিবাচক চরিত্রের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক পরিণতি হলো জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসের ক্ষয়। গণতন্ত্র জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। নির্বাচিত ব্যক্তিরা জনগণের স্বার্থে ন্যায্যতা এবং সততার সঙ্গে কাজ করবেন। যখন নেতারা নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন বা তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো পালন করতে ব্যর্থ হন, তখন জনগণের আস্থা হ্রাস পায়। এই বিশ্বাসের ক্ষয় গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এটি নাগরিকদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীন করে তোলে। যখন মানুষ আর বিশ্বাস করতে পারে না যে, তাদের কণ্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ বা তাদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে সক্ষম, তখন ভোটারদের উপস্থিতি কমে যায় এবং উদাসীনতা শুরু হয়। এটি একটি বিপজ্জনক চক্র তৈরি করে, যেখানে হতাশ জনগণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ফলে অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
একনায়কতন্ত্রের উত্থান : রাজনীতিকদের অসৎ চরিত্র একনায়কতন্ত্রের উত্থানের পথ প্রশস্ত করতে পারে। যখন নির্বাচিত নেতারা গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ত্যাগ করেন এবং ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যবস্থাগুলোকে কৌশলে বিকৃত করেন, তখন তারা শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি পরিবর্তন করার ঝুঁকি নেন। একনায়কতান্ত্রিক নেতারা সাধারণত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন করে, যেমনÑ বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম এবং বাকস্বাধীনতা, যা তাদের শক্তিকে জোরদার করতে সহায়ক। তারা জনগণের হতাশা এবং দুর্নীতির প্রতি ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ভীতি, প্রচার এবং মিথ্যার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখেন। চরম ক্ষেত্রে, এমন নেতারা সংবিধানকে দুর্বল করতে, নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত করতে এবং বিরোধিতা দমন করতে পারে, যা গণতন্ত্রকে তার স্বরূপের একটি ছায়ায় পরিণত করে। কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত হওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন, সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। অবশেষে, গণতন্ত্রের পতন ঘটে রাজনীতিকদের নৈতিকতার অভাবে। যারা তাদের ব্যক্তিগত এজেন্ডাকে স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের, মূল্যবোধের ওপরে অগ্রাধিকার দেয়।
শাসনের ওপর প্রভাব : যখন অসৎ চরিত্রের রাজনীতিকরা রাজনীতির দৃশ্যে আধিপত্য বিস্তার করেন, তখন এটি কার্যকর শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুর্নীতি এবং অসৎ আচরণ প্রায়ই সম্পদের ভুল বিতরণ, সরকারি সেবার অকার্যকারিতা এবং জবাবদিহির অভাবের দিকে নিয়ে যায়। নীতিমালাগুলো প্রায়ই রাজনৈতিক দলবাজি এবং বন্ধুবান্ধবদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে গৃহীত হয়। এর ফলে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হতে পারে, সামাজিক সেবা অপ্রতুল হতে পারে এবং বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং পরিবেশগত টেকসই তার মতো জরুরি সমস্যাগুলোর সমাধান ব্যাহত হয়। তা ছাড়াও রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে ওঠে বিষাক্ত। যখন অসততা এবং অশোভন আচরণ স্বীকৃত হয়ে যায়, তখন ভালো চরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তিদের জনসেবায় আকৃষ্ট করা আরও কঠিন হয়ে ওঠে। সরকারি অফিস জনসাধারণের কল্যাণের জন্য নয়, বরং ব্যক্তিগত লাভের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখা হতে পারে। যখন নেতৃত্বের মান আরও নেমে আসে, জনগণ এবং সরকারের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়ে এবং দুর্বল হয়ে পড়ে গণতন্ত্র।
রাজনীতির চরিত্র পুনরুদ্ধার : রাজনীতিকদের চরিত্রের ফলে গণতন্ত্রের পতন অপ্রতিরোধ্য নয়। যদিও এটি একটি অন্ধকার চিত্র মনে হতে পারে, তবে সততা পুনর্প্রতিষ্ঠা করা এবং নেতাদের উচ্চ নৈতিক মান বজায় রাখতে নিশ্চিত করার জন্য কিছু পথও রয়েছে।
গণতন্ত্রের পতন প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো শক্তিশালী জবাবদিহি ব্যবস্থা তৈরি করা। স্বচ্ছতা, স্বাধীন গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের সংগঠন এবং শক্তিশালী আইনগত কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য, যাতে রাজনীতিকরা তাদের কাজের জন্য দায়ী হন। ঘুষ, দুর্নীতি এবং অন্যায় আচরণ প্রকাশ করতে এবং এসব প্রতিরোধ করতে আইনি সুরক্ষা এবং অ্যান্টিকরাপশন উদ্যোগগুলো সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়াও নাগরিক অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সজাগ এবং সুশিক্ষিত করা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে তারা তাদের নেতাদের নির্বাচনে বিচক্ষণ এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ভোটারদের তাদের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি দাবি করতে হবে এবং যারা সিস্টেমকে অপব্যবহার করতে চায় তাদের চিহ্নিত ও প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, গণতন্ত্রের পতন প্রায়ই রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ডের কারণে ঘটে, যারা কার্যকর শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। যখন রাজনৈতিক নেতারা জনগণের স্বার্থের বদলে নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন, তখন গণতন্ত্রের ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা এবং সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহপণের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে, দুর্নীতি এবং অসৎ আচরণের মুখেও গণতন্ত্র শক্তিশালী থাকবে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নেতাদের দায়ী করা এবং সিস্টেমে বিশ্বাস পুনর্প্রতিষ্ঠা করার জন্য যৌথ প্রচেষ্টার ওপর।

×