ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ ও বিশ্বজনীন বার্তা

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২০:১৩, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ ও বিশ্বজনীন বার্তা

 

 

 

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠান একটি ঐতিহাসিক আলোচিত ঘটনা। গত ৫ নভেম্বর ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশটির সংবিধান বা রীতি অনুসারে নির্বাচনের আড়াইমাস পর হোয়াইট হলের দখল লাভ করেন। ২০ জানুয়ারি ২০২৫ মহেন্দ্রক্ষণটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ব রাজনীতির পরিমণ্ডলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি বরাবরই বিশ্ববাসীর কাছে সীমাহীন আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকে। কেননা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী তথা শক্তিশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকেই গণ্য করা হয়ে থাকে। কেবল কাগজে কলমে নয় বাস্তবিক কারণেই দেশটি শক্তিধর রাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর একক পরাশক্তির দেশে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির অর্থনীতি গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে থাকে। গণতান্ত্রিক বৃহৎ রাষ্ট্রের তালিকায় শীর্ষস্থান দখলকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্যত গোটা বিশ্বের মোড়ল হিসেবে বিবেচিত। দেশটিকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও দিন শেষে সকলেই দেশটির নীতির দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশ্ব যত অশান্তি যুদ্ধাবস্থা হানাহানি, বিভিন্ন দেশে সরকার পতন ও নতুন শক্তি উত্থানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করা হয়ে থাকে অনেক ক্ষেত্রে। আবার গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রধানরূপে গণ্য করা হয়। সে জন্যেই দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। অনেকের ধারণা বা হরহামেশাই বলতে শোনা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের শাসক বদলালেও বিদেশনীতির কোনো বদল হয় না। একথাটি আপেক্ষিত সত্য তবে সর্বাংশে নয়। সুনির্দিষ্ট একটি কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিকাশমান ধারায় চলমান থাকলেও ব্যক্তির মনস্তত্ব দর্শন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশাসনিক ছকে ভিন্নতা নিয়ে এসেছেন। বৈদেশিক সম্পর্কের গতিপথটাও অনেকটা বদলে দিয়েছেন। আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে- তার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন বিভিন্ন বক্তব্যে। তিনি ‘ফাস্ট আমেরিক’ নীতি ঘোষণা করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে- আগে তার দেশ ও জনগণের স্বার্থ। তারপর বিদেশ।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের চিরাচরিত প্রথা ভাঙ্গার শপথ অনুষ্ঠানটি বিশ্বজনীন নতুন বার্তার আবহে দেদীপ্যমান হতে পারে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশকেই তার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। ইতোপূর্বে এরকম ঘটনা ঘটেনি দেশটিতে। আমন্ত্রিত দেশের প্রতিনিধিগণের উপস্থিতি একটি বিশ্বভ্রাতৃত্বের পরিবেশকেই ইঙ্গিত করে। উল্লেখ্য, গোটা বিশ্বই এখন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় কোনো কোনো দেশের অর্থনীতি পঙ্গুত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জনজীবন হয়ে উঠেছে ওষ্ঠাগত। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষকে খুবই কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশে^র সকল নেতৃত্বকে এক ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মানবজাতির কষ্টকে দূর করতে হবে। মনে রাখা দরকার, এই পৃথিবীর যে প্রান্তেই জন্ম হোক না কেন সকল জায়গায় বিচরণ বা বসবাস করার অধিকার মানব জাতির রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তনের কথা বলেছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশটিতে প্রবাসীরা বাস করতে পারবে কি পারবে না এমন শঙ্কা কাজ করলেও ট্রাম্প কিন্তু তাড়িয়ে দেওয়ার কথা কখনো বলেননি। একদিকে  যেমন বিশ্বর অনাহারি  কঙ্কালসার মানুষগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধন করেছেন। আবার ধনী ব্যবসায়ীদের দেশ পরিচালনার অংশীদার করে বিশ্বকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প কেবল নিজের জীবনের কথা ভাবেননি। তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, নিজের জীবনের কথা ভাবলে শ্রেষ্ঠ আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব নয়। মনুষ্য সমাজে প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্যে ভূমিকা পালনকারীর সংখ্যা খুব কমই আছে। কিছু দুষ্টলোক সরকারের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও লুকিয়ে লুকিয়ে বনে শিকার করে, সুন্দর পাখি, দুষ্প্রাপ্য প্রাণী এবং গাছপালা নষ্ট করে। তারা কেন এগুলো করে? উত্তর হচ্ছে, এগুলো বিক্রয় করে প্রচুর অর্থ লাভ করতে চায়, আরামের জীবন যাপন করার উদ্দেশ্যে। এ হচ্ছে পঙ্কিল জীবন যাপন। এদের আনন্দ কেবল ইন্দ্রিয় ভোগে। ইন্দ্রিয়শক্তি চরিতার্থ করা একটা সীমার মধ্যে থাকলে তা ভালো হতে পারে; কিন্তু সীমাকে অতিক্রম করে গেলে তা বিপজ্জনক হতে পারে। এ সব বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা ও সভা হয়। যেমনÑ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে অনেক সম্মেলনে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়; করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। আন্তর্জাতিক আলোচনায় মানুষের প্রয়োজন ও তার চাহিদাÑ এ দুইয়ের মধ্যে একটা পার্থক্য করা হয়। গান্ধীজী বলেছিলেন, ‘মানুষের প্রয়োজন মেটাবার জন্য যথেষ্ট জিনিস পৃথিবীতে আছে, কিন্তু তা চাহিদা মেটাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়, চাহিদা যেন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এই চাহিদার জায়গা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত বহন করছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানকে ঘিরে।
অনেকের কাছে এটি বেখাপ্পা লাগতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সর্বজন মতের সমন্বয় ঘটানো জরুরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর অর্থই হচ্ছে সমন্বয় সাধন। সমন্বিত উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যেই এমন আয়োজন। ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও খ্যাতিমান শিল্পী, ধনকুবেরগণ আমন্ত্রিত হন। ন্যাশনাল মল থেকে বিশালাকারের ভিডিও স্ক্রিনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি সকলেই দেখার সুযোগ গ্রহণ করেন। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচরাপতিই শপথবাক্য পাঠ করিয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলের কংগ্রেস ভবনের একাংশে শপথ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। রীতি অনুযায়ী শপথের পর নতুন প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। ট্রাম্পের সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ড্যান্সও শপথ নেন। জমকালো অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের দেশাত্মবোধক গান পরিবেশিত হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। উল্লেখ্য, শপথ গ্রহণের আগের রাতে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল ওয়ান এরিনায় ‘মেক আমেরিকা গ্রেট’-এগেইন ভিক্টরি র‌্যালি করেন ট্রাম্প।
যাহোক, রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা প্রচলিত উক্তি যে, ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে, সর্বময় ক্ষমতা সম্পূর্ণ দুর্নীতিগ্রস্ত করে। ইতিহাসে প্রায় সমস্ত ক্ষমতাবান শাসকের ক্ষেত্রে এ উক্তিটি প্রমাণিত হয়ে আসছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে যেন সর্বময় ক্ষমতা দুর্নীতি মুক্ত রাখে, কথাটি বাস্তবে রূপ লাভ করে, এ প্রত্যাশা বিশ্ববাসীর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যদি সৎ ও আদর্শবান হন তবে এ আদর্শ বিশ্বের অন্যান্য নেতাদের প্রেরণা জোগাবে। যে ব্যক্তি সমাজে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত; যে ব্যক্তি অর্থে, বুদ্ধিতে বা রাজনীতিক ক্ষমতায়, যে কোনো একটিতে; অন্যকে ছাড়িয়ে যায় তাকেই সেই সমাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। সে যা করে, অন্যে তাকে অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। এ হচ্ছে মানব সমাজের প্রকৃতি। নেতা যদি নীতিভ্রষ্ট হয়, তবে সে জাতির প্রায় সকলেই নীতিভ্রষ্ট হবে। নীতিভ্রষ্টতা ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত সমাজে। সুতরাং নেতার চরিত্র অবশ্যই উচ্চমানের হওয়া চাই। সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, ‘হে অর্জুন আমার দিকে তাকাও, এ জগতে আমার কিছু লাভ করার নাই, তবু আমি সর্বক্ষণ নিজেকে কাজে নিযুক্ত রাখি।’ সমাজ থেকে তোমার কিছু লাভ করার প্রয়োজন থাকলেই তার প্রতিদানের কথা ভেবেই কর্তব্যবোধ আসে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি। ঈশ্বরাবতার হয়েও শ্রীকৃষ্ণ রাজনীতিক নেতা, আধ্যাত্মিক আচার্য, দার্শনিক, নানা ভূমিকায় কাজ করেছেনÑ এ বর্ণনা আছে মহাভারতে। প্রত্যেকেই নির্দেশের জন্যে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতো, তিনি তো অনায়াসেই অলস জীবন যাপন করতে পারতেন কোনো কাজ করতে হতো না। প্রয়োজনমতো সবকিছুই পাওয়া সম্ভব ছিল। তবু তিনি অতীব কর্মব্যস্ত থাকতেন। পান্ডব ও কৌরব বংশের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্যে সওয়াল করতেন। যুদ্ধ এড়াতে ও কৌরবদের কাছে প্রার্থনা করতে- পান্ডবদের অর্ধরাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। অন্যথায় অন্তত পাঁচখানি গ্রাম দেওয়ার জন্যও ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করেন। শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতিক ও কূটনীতিক কথাগুলোর প্রতিধ্বনি ট্রাম্পের ভাষণের মধ্যে  যেন ফুটে ওঠে। এমনকি আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রসংঘের বিভিন্ন ভাষণগুলোর মধ্যেও এর প্রতিধ্বনি লক্ষণীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন যাত্রায় বিশ্ব নতুন মাত্রায় শান্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক। দেশে দেশে যে যুদ্ধ হচ্ছে, তা বন্ধে ট্রাম্প যেন ভূমিকা গ্রহণ করেন- এই প্রত্যাশা সবার। সূচনা হোক এক নতুন বিশ্বের।  

লেখক :  রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

×