বাক্স্বাধীনতা হলো এমন একটি নীতি যা প্রতিশোধ, সেন্সরশিপ বা আইনি অনুমোদনের ভয় ছাড়াই একজন ব্যক্তি বা সম্প্রদায় তাদের মতামত এবং ধারণা প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত করা হয়েছে। এই বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নেই সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বাতিল করে প্রণয়ন করা হচ্ছে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪। বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৭ ধারা দিয়ে শুরু; এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ‘সংস্করণ’ সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩; বিগত শাসনামলের বিভিন্ন সময়ে এই আইনগুলো হয়ে উঠেছিল সাইবার স্পেসে মানুষের মতপ্রকাশের জন্য বড় বাধা বা হুমকি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ নিয়ে আজকের নিবন্ধ। এতে আলোচনা করার চেষ্টা করব প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ইতিবাচক পরিবর্তন, বিতর্কিত কোন্ কোন্ ধারা বহাল রাখা হয়েছে অধ্যাদেশে এবং কোন্ প্রসঙ্গগুলো যুক্ত করলে অধ্যাদেশটিকে আরও প্রাসঙ্গিক করা সম্ভব হতে পারে সে বিষয়ে।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এমন কিছু বিষয় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে এবং নতুন যুক্ত করা হয়েছে, যা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষকে আশঙ্কামুক্ত করতে পারেনি। প্রথম উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন হলো, উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত অধ্যাদেশের ধারা ২-এর ভ অনুসারে ‘সাইবার সুরক্ষা’ হিসেবে নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এ অধিকার ক্ষুণ্ন হলে কোথায়, কিভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কেউ যদি কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করে, তাহলে কী শাস্তি হবে, সেটাও এখানে উল্লেখ নেই। এক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া এবং কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তির বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা জরুরি ছিল। প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ধারা ২০-অনুসারে সাইবার স্পেসে জুয়াখেলার অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জুয়াখেলার জন্য কোনো অ্যাপ, ডিভাইস তৈরি বা খেলায় অংশগ্রহণ বা সহায়তা করলে এবং উৎসাহ দিতে বিজ্ঞাপনে অংশ নিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
বাতিল করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারার সঙ্গে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ২৫ ধারার ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও মর্মগতভাবে তেমন কোনো পার্থ্যক্য নেই। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে নতুনভাবে ব্ল্যাকমেলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশের বিষয়টি সংযোজন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় ‘কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার’ করাকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে প্রায় একই রকম কথা রয়েছে। নারী ও শিশুদের সুরক্ষার জন্য এ ধারায় ‘সাইবার বুলিং’কে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছেÑ এমনটা দাবি করেছেন সরকার সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ। ‘সাইবার বুলিং’-এর আওতার মধ্যে যেসব কাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোকে সুবিধামতো ব্যাখ্যা করার সুযোগ এই ধারায় রয়েছে। এতে অনেক ধরনের সমালোচনাকেই ‘সাইবার বুলিং’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে। ফলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে যেমন কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিযোগে মানুষকে নিপীড়ন ও হয়রানি করা হতো, একইভাবে ‘সাইবার বুলিং’-এর অভিযোগে মানুষকে নিপীড়ন ও হয়রানি করার সুযোগ তৈরি হবে। এ ধারায় ব্ল্যাকমেলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ‘ব্ল্যাকমেলিং’-এর একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও ‘অশ্লীল’ বিষয়বস্তুর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ‘অশ্লীল’ বা ‘অশ্লীলতা’ খুবই আপেক্ষিক বিষয়। দেশ-কাল-সংস্কৃতিভেদে ‘অশ্লীল’ বিষয়বস্তু একইরকম হয় না। ফলে, এটা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। তথাপি বিষয়টি ইতিবাচক বিবেচনায় অধ্যাদেশের এই বিধানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ধন্যবাদ পেতে পারে।
তবে, কিছু বিষয় আশাহত করেছে। পুরনো আইনের কিছু ধারা খসড়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে বহাল রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা নতুন আইনে যুক্ত করায় তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৮(১) ধারার মতো সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ৮(১) ধারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে বিটিআরসিকে (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) যে কোনো কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করার যে কারণগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা অস্পষ্ট ও বিস্তৃত। ফলে এগুলোর অতিরিক্ত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা দেশের সংহতির মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করায় তা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) অনুমোদিত সীমার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়নি।
বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৭ ধারাটি প্রায় হুবহু সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ২৩ ধারায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শুধু দণ্ডের পরিমাণ অনধিক ১৪ বছর থেকে কমিয়ে ১০ বছর করা হয়েছে। প্রায় একই রকম একটি ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় ছিল। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ২৬ ধারায় কিছু শব্দ সংযোজন-বিয়োজন এবং ভাষাগত পরিবর্তন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী এ ধারায় প্রয়োজনীয় স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের বিষয়টি ছিল। খসড়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ৩৫ ধারায় পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা একইভাবে বহাল রাখা হয়েছে। তবে এখানে নতুন একটি উপধারা যোগ করে গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে অনতিবিলম্বে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট বা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটির জন্য কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ৪৬ ধারায় এ অধ্যাদেশের অধীন কোনো অপরাধসমূহ জামিনযোগ্য ও অজামিনযোগ্য তা উল্লেখ করা হয়েছে। খসড়া অধ্যাদেশের ধারা ১৭, ১৮-এর (১) (গ), ধারা ১৯, ২২, ২৩ এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ অজামিনযোগ্য। এই অপরাধসমূহের ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিচার-পূর্ব আটকের বিকল্প কোনো সুযোগ থাকে না। অর্থাৎ, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিচার-পূর্ব আটক রাখা হয়। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ইতিবাচক বিষয়গুলো প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু অধ্যাদেশের খসড়া ওয়েবসাইটে দিয়ে তা নিয়ে মতামত জানানোর জন্য মাত্র তিনদিন সময় দেওয়া হয়েছিলÑ বিষয়টি অপ্রত্যাশিত। অন্যদিকে অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে গভীর পর্যালোচনা এবং আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে যথাযথভাবে ও অর্থবহ সংলাপ বা মতবিনিময় হয়নি। যদি বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে যথাযথভাবে আলোচনা হতো, তবে সেটি আরও অর্থবহ হতো। কাজেই সার্বিক দিক থেকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে কি না, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর ধারা ২-এর ভ অনুসারে ‘সাইবার সুরক্ষা’ হিসেবে নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ হচ্ছে সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকার ক্ষুণ্ন হলে একজন নাগরিক কোথায়, কিভাবে প্রতিকার পেতে পারেন, সে সম্পর্কে একটি পৃথক ধারা যুক্ত করে আইনগত প্রতিকার নিশ্চিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি অন-লাইন ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট বিধানসহ একটি ধারা যুক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এআই অর্থাৎ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রসঙ্গটিকেও পৃথক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। প্রত্যাশা করছি, গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি চমৎকার আইন প্রণয়ন করতে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
লেখক : আইনজীবী ও গবেষক