ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

লস অ্যাঞ্জেলেস অগ্নিকাণ্ড ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

খন্দকার আপন হোসাইন

প্রকাশিত: ২০:১৪, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

লস অ্যাঞ্জেলেস অগ্নিকাণ্ড ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

নতুন বছরের শুরুতেই ইতিহাসের ভয়াবহ দাবানলের সাক্ষী হয়েছে বিশ্ববাসী। গত ৭ জানুয়ারি, ২০২৫ দাবানলের বহ্নিশিখায় তলিয়ে যায় লস অ্যাঞ্জেলেস। জ্বলন্ত আগুনে নিরন্তর পুড়ে চলা এখনো থামেনি। এরইমধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে আরও ১৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে। আগুন নেভেনি। কবে নিভবে এই আগুন তা সঠিকভাবে বোঝাও যাচ্ছে না। অগ্নিকাণ্ড নানাবিধ কারণে হয়ে থাকে। লস অ্যাঞ্জেলেস ঠিক কি কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এমন ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড ঘটার নেপথ্যে কী রয়েছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক কাঠামো ৫০টি রাজ্যে বিভক্ত। প্রতিটি রাজ্য আবার অনেক কাউন্টিতে বিভক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একটি রাজ্য হলো ক্যালিফোর্নিয়া। ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যটি মোট ৫৮টি কাউন্টিতে বিভক্ত। ক্যালিফোর্নিয়ার উল্লেখযোগ্য কাউন্টিগুলোর মধ্যে অন্যতম দুটি কাউন্টি হলো সান ফ্রান্সিসকো এবং লস অ্যাঞ্জেলেস। সান ফ্রান্সিসকোর অবস্থান উত্তরভাগে আর দক্ষিণভাগে লস অ্যাঞ্জেলেসের অবস্থান। ক্যালিফোর্নিয়া আবিষ্কৃত হয় ১৭৫৯ সালে। পাহাড় বন-জঙ্গল আর মহাসাগরে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য ক্যালিফোর্নিয়া। সৌন্দর্যে আর বৈভবে সমৃদ্ধ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম দর্শনীয় স্থান হলেও ভৌগোলিক মানদণ্ডে বেশ স্পর্শকাতর। ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরভাগ ভূমিকম্পপ্রবণ আর দক্ষিণভাগ দাবানলপ্রবণ। লস অ্যাঞ্জেলেসর আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য হলো ঝড়ো সামুদ্রিক বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিক স্বল্পতা। প্যাসিফিক প্যালিসেড পর্বত শ্রেণি লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে অবস্থিত। পুরো পাহাড়জুড়ে ঘন পাইন, সিডার এবং সারি সারি রেডউড গাছ। প্যাসিফিক প্যালিসেড পাহাড়টির উত্তরে সান্তা মনিকা পাহাড় আর দক্ষিণে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই অঞ্চলটি সহসাই কেমন দানবের মতো গর্জে উঠল। পাহাড়ের বনের মধ্যে জ্বলে উঠল দাবানলের লেলিহান শিখা। তীব্র আগুনের উত্তাপে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুহূর্তেই পরিণত হয়ে গেল প্রাকৃতিক দুর্যোগে।
যেখানে বৃষ্টিপাত কম হয়, সেখানে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফলে সৃষ্টি হয় খরা। খরার ফলে গাছপালা শুকিয়ে মারা যায় আর পরবর্তী সময়ে এগুলো দাহ্য পদার্থে পরিণত হয়। বছর বছর ক্রমান্বয়ে এভাবে চলতে থাকলে সে অঞ্চলে দাবানল হবেই। যেমনÑ সাম্প্রতিক দাবানলের কেন্দ্রবিন্দু হলো লস অ্যাঞ্জেলেস। তথ্য ঘাটলে জানা যায়, ২০২৪ সালের গ্রীষ্মকালে এই অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ চলেছে। শরৎকাল কিংবা শীতকালেও উষ্ণতার প্রভাব কমেনি। শহরের কেন্দ্রস্থলে অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ০.১৬ ইঞ্চি। ০.১৬ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাতের থেকে ৪ ইঞ্চি কম। গবেষকরা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন আর অত্যধিক কম আর্দ্রতা শুকিয়ে যাওয়া বিশাল বন্যভূমিকে দাবানলপ্রবণ করে তুলেছে। লক্ষাধিক মোটরযান থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া যতটা না পরিবেশের ক্ষতি করে, তার চেয়েও শতগুণে বেশি ক্ষতি করে একটি দাবানল। দাবানলের আগুনে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যায় বৃক্ষরাজি। ফলে বাতাসে কার্বনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। গাছ পোড়া কালো কার্বন গ্রীনহাউস গ্যাসের থেকেও কয়েক হাজার গুণ বেশি ক্ষতিকারক। দাবানলের আগুন নিভে যাওয়ার পরেও ক্ষয়িষ্ণু বনগুলো থেকে আরও অনেক ক্ষতিকারক বস্তু নির্গত হয়, যা পরিবেশের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃতি মোটেই দায়ী নয়। মানুষের ভুলত্রুটি, অসংগতি, অসতর্কতা ও অসচেতনতাই দাবানল সৃষ্টির নেপথ্য কারিগর। মাঝেমাঝেই বৈদ্যুতিক পাওয়ার লাইন থেকে অগ্নিসংযোগ হয়ে দাবানলের সৃষ্টি হয়। বৈজ্ঞানিক ধারণামতে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বজ্রপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। অনেক সময় বজ্রপাতের ফলেও দাবানলের সৃষ্টি হয়। বৃক্ষ নিধন কিংবা বৃক্ষ শুকিয়ে যাওয়ার ফলে উষ্ণায়ন বৃদ্ধি পায়। ফলে দাবানলের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। প্রবল খরা আর বিষাক্ত পোকামাকড়ের জন্য ১৬৩ মিলিয়ন গাছ শুকিয়ে মারা গেছে। ২০২২ সালের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী দাবানলের আগুন প্রতিরোধকারী যেসব যন্ত্রপাতি আছে, তা সব সময় ঠিক মতো কাজ করে না। সম্প্রতি বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের আগুন থেকে বিগ বেসিন রেডউড স্টেট পার্কে আগুন লেগেছিল। ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিশেষ পর্যবেক্ষণেই থাকে। লস অ্যাঞ্জেলেসর বাতাসে গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন রোধে মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিশেষ প্রযুক্তিকরণ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তারপরও দাবানল থেকে রেহাই মেলেনি। সপ্তাহব্যাপী দাবানলে সৃষ্ট ধোঁয়া বাতাসে যে পরিমাণ গ্রীন হাউস গ্যাস ছড়িয়েছে, তাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের গড় আয়ু কমিয়ে দিয়েছে ১.৭৮ শতাংশ। আর এক গবেষণায় এসেছে, দাবানলের আগুন নেভাতে যে সব রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়, তা বাতাসকে আরও দূষিত করে তোলে।
লস অ্যাঞ্জেলেসর পার্শ্ববর্তী কাউন্টি সিয়েরা নেভাডা পাহাড়ের প্যারাডাইস বনাঞ্চল ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর এক মারাত্মক দাবানলের কবলে পড়েছিল। প্যাসিফিক গ্যাস অ্যান্ড ইলেকট্রিক কোম্পানির ট্রান্সমিশন লাইনে কিছু যান্ত্রিক গোলযোগের ফলে সেখানে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটেছিল। তখন খুব ঝোড়ো বাতাস বইছিল। মুহূর্তের মধ্যে সেই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ দাবানলের আকার নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল এক লাখ তেপ্পান্ন হাজার একর সুবিস্তৃত অঞ্চল। পুড়ে ছারখার হয়েছিল উনিশ হাজার ঘরবাড়ি। প্রাণ হারিয়েছিল পঁচাশি জন। কয়েক সপ্তাহব্যাপী জ্বলন্ত সেই দাবানলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল এক শ’ পঁয়ষট্টি বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি সংঘটিত লস অ্যাঞ্জেলেস দাবানলকে সেই দাবানলেরই পুনরাবৃত্তি মনে করা হচ্ছে।
ইদানীং বিশ্বব্যাপী দাবানলের গতিপ্রকৃতি আর চারিত্রিক ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। দাবানল প্রতিরোধ খাতে ২০০৫-০৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ফায়ার সার্ভিসের বাজেট ছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে দাবানল প্রতিরোধ খাতের বাজেট বেড়েছে ৪.৩ বিলিয়ন ডলার। দাবানলের আগুনে ফসলেরও ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচুর। এবারের লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হলো প্যাসিফিক প্যালিসাডেস এবং আল্টাডেনা। নামকরা হলিউড তারকাদের বাহারি বাসভবনের জন্য সুনাম রয়েছে এই অঞ্চলের। সেগুলোও আগুনের করাল গ্রাসে চলে গিয়েছে। ১ লাখ ৮০ হাজার বাসিন্দাকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও পুরোপুরি মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হয়নি। আগুনের তীব্রতা থেকে বীভৎস চেহারা দেখেছে মানুষ। দক্ষিণ ক্যালিফর্নিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৩ লাখ ঘরবাড়ি। প্রায় ১ লাখ বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। জানা যায়, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী পালিসাডেস এলাকায় প্রথম দাবানলের আগুন প্রবেশ করে। এরপর আগুন এগিয়ে যেতে থাকে শহরের দিকে। শুষ্ক, ঝড়ো হাওয়ায় আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। লস অ্যাঞ্জেলেসের কোথাও কোথাও আগুনে-হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বা এরও বেশি। বিলাসবহুল প্রাসাদ আর বাংলোয় সাজানো লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের বহুলাংশ এখন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। শেষ হয়ে গেছে খাবার পানি। বিদ্যুৎহীন বিস্তীর্ণ এলাকা।
ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে শান্তা আনা ঝড় ৬০ থেকে ৭০ মাইল বেগে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলের দিকে বইতে শুরু করে। গত এক দশক ধরে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় দীর্ঘ খরার ফলে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। গাছপালা ঝোপঝাড় প্রায় শুকিয়ে গেছে। ফলে সহজেই বনের মধ্যে দাবানল সৃষ্টি হয়ে যায়। বস্তুত জলবায়ুর চারিত্রিক পরিবর্তনই দাবানল সৃষ্টির জন্য বিশেষভাবে দায়ী। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে নতুন নতুন নামে দাবানলের আক্রমণ আমরা লক্ষ্য করছি। নামকরা বিভিন্ন ঝড়ের মতো দাবানলেরও নিত্যনতুন নামকরণ আমরা দেখেছি। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দাবানল হলো ফায়ারনাডো, গিগাফায়ার, ফায়ার সিজ। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলীয় দাবানলÑ যা সাধারণত মরুভূমির সহায়তায় সৃষ্টি হয়।
দাবানলের মতো দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? গবেষণা চলছে, পর্যালোচনা চলছে, আলোচনা চলছে। সমাধান কি মিলেছে? সন্দেহজনক স্থানে দাবানলের গতি-রোধকযন্ত্র স্থাপন করতে হবে। বড় বড় বনের ইকোসিস্টেম যেন সম্পূর্ণরূপে নষ্ট না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। দাবানল প্রবণ অঞ্চলসমূহে শত শত সেন্সর দিয়ে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। পাহাড়ের চূড়ায় শক্তিশালী ক্যামেরা স্থাপন করে দাবানলবিষয়ক নজরদারি বাড়াতে হবে। ক্যামেরা ও স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য সুপারকম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে আগুনের ঝুঁকির মডেল তৈরি করতে হবে। সিএফসি নির্গত হয় এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কল কারখানা ও মোটরযানের ধোঁয়া রোধ করতে হবে। সর্বোপরি মানব সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই।


লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
[email protected]

×