অনেক বিতর্ক, চিঠি চালাচালির পর জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শেষ পর্যন্ত এনআইডি থাকছে নির্বাচন কমিশনের হাতেই। বিগত সরকারের আমলে এই পরিষেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ জন্য বিগত সরকারের আমলে ২০২৩ সালে আইনও পাস করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ’২৩ সালের আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন নিজে। তিনি জানান, ওই আইন বাতিল করতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। চিঠি আমলে নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ফলে, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নির্বাচন কমিশনের অধীনেই থাকছে। এ জন্য সিইসি সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
২০২১ সালে বিগত সরকার এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনের পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণ রয়েছে। রাষ্ট্রের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এই দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। এ জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র আইন-২০১০ সংশোধন করা যেতে পারে।’ দায়িত্ব হস্তান্তরের লক্ষ্যে ২০২৩ সালে আইনের একটি সংশোধনীও আনা হয়। তখনই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল নির্বাচন কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘এনআইডির কাজ অন্য বিভাগে গেলে ভোটার তালিকা করা ও তা হালনাগাদ, নির্বাচনসহ বিভিন্ন সমস্যা হবে। এটি সংবিধানবিরোধী।’ ইসির এই মতামতের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাল্টা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ইসিকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘সরকার জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায়, নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে তারাও মনে করেন, এনআইডি সেবা কমিশনের হাতে থাকা উচিত। সম্প্রতি কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয় এবং ইতোপূর্বে নেওয়া সরকারের সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সে অনুযায়ী সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
শেষ পর্যন্ত এনআইডি কার্যক্রম রাষ্ট্রের যে বিভাগের হাতেই থাকুক না কেন, এর সেবার মান আরও বৃদ্ধি করা জরুরি। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া নাগরিক জীবন অচল। জমি রেজিস্ট্রি থেকে শুরু করে ফোনের সিমকার্ড কেনা পর্যন্ত সকল কাজে এনআইডি অপরিহার্য। পাসপোর্ট তৈরি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা, অনেকক্ষেত্রে ব্যাংকে লেনদেন, গাড়ি কেনা, অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের টিকিট কেনা, বাসা ভাড়া নেওয়া থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা এনআইডি ছাড়া করা যায়। লঞ্চ ও ট্রেনের টিকিট কিনতেও এনআইডি প্রয়োজন। সকল ক্ষেত্রে এনআইডির ব্যবহারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার ধারণা থেকে এই কার্ড ইস্যু করা হয়। বিশে^র সব দেশেই এ ধরনের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকে। একেক দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে এই কার্ড চালু রয়েছে। আধুনিক বিশে^ এমন একটি জাতীয় কার্ড ছাড়া নাগরিক জীবন কল্পনাও করা যায় না। নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্র এই কার্ডের মাধ্যম সকলকে প্রশাসনিক নেটওয়ার্কে যুক্ত রাখে।
প্রায় ২৮ বছর আগে দৈনিক জনকণ্ঠ এমন একটি কার্ড চালু করার সুপারিশ করেছিল। ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি পর্যবেক্ষণ নিবন্ধে বলা হয়েছিল, ‘সকল নাগরিকের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র চালু করা প্রয়োজন। এতে নাগরিকদের সব তথ্য সংবলিত ডাটা ব্যাংক গড়ে তোলা হবে। এমন একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারলে সরকারের সব সেবা এক ছাতার নিচে আনা সম্ভব হবে।’ জাতীয় পরিচয়পত্রের যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে। ২০০৮ সালে সকল নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়। এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০১০ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে খুব একটা সিরিয়াস মনে হয়নি। প্রায় দুই দশক পরেও এনআইডির সেবা পেতে নাগরিকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। যেহেতু ভোটার আইডি কার্ড থেকে এনআইডির ধারণা এসেছেÑ তাই, এর দায়িত্ব পড়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। একটি প্রকল্প তৈরি করে কমিশন এই দায়িত্ব পালন করছে। অতীতে দিনের পর দিন নির্বাচন কমিশনের দরবারে ঘুরে সেবা না পেয়ে চরম বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন অনেকে। নাগরিকরা তাদের সমস্যা নিয়ে ইসির মাঠ পর্যায়ে যোগাযোগ করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তখন পত্রপত্রিকায় এনআইডি বিড়ম্বনার অনেক ঘটনার কথা ছাপা হয়েছে।
২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা করার পর থেকে এত বছরেও নাগরিকদের তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি। প্রথমদিকে দেওয়া অনেক তথ্যই এখন পুরনো হয়ে গেছে। বদল হয়েছে ঠিকানা। এগুলো সংশোধনে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে নাগরিকদের। হাতে গোনা কিছু ভাগ্যবান হয়তো এই সেবা নিতে পেরেছে। অধিকাংশই ঘুরছে বছরের পর বছর। নাগরিক ভোগান্তি দূর করতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় এনআইডি সেবা কার্যক্রম। সংশোধন, হারানো কার্ড উত্তোলন এবং নতুন কার্ড মুদ্রণে মাঠের উপজেলা অফিস, জেলা অফিস, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনু বিভাগের (এনআইডি) কার কী ক্ষমতা তা-ও নির্ধারিত করা হয় প্রজ্ঞাপনে। তারপরও যেন ভোগান্তি কমছেই না। এসএসসি সনদধারীরা কিছুটা সেবা পেলেও যাদের কোনো সনদ নেই, এনআইডি সংশোধনে বেশি বেগ পেতে হয় তাদের।
অসম্পূর্ণ এনআইডি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যর মুখোমুখি হতে হয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে। অসম্পূর্ণ এনআইডির জন্য পাসপোর্ট আটকে রাখা হয়েছে মাসের পর মাস। পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে অনেক আবেদনকারী এনআইডি সংশোধনের জন্য ছুটতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত কোনোটাই আর সময়মতো হয়ে ওঠেনি। এমন অনেক ভুক্তভোগীর কথা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে; যারা শুধু এনআইডি সেবার জন্য সময়মতো পাসপোর্ট পায়নি। পাসপোর্টের কারণে বিদেশে চাকরিতে যোগদানের সময়সীমাও শেষ হয়ে গেছে। নানা অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্যে ভরপুর থাকে এনআইডিতে। তথ্য ভাণ্ডারে কোনো কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত স্ট্যাটাসে ম্যাডনেস, ইনকমপ্লিট, ম্যাচ নট ফাউন্ড, ম্যাচ ফাউন্ড, মৃত ভোটার, তথ্য ডিলিট প্রদর্শিত হচ্ছে।
২০০৮ সালে দেশের ৮ কোটি ১০ লাখ মানুষকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এরপর দফায় দফায় আরও অনেক এনআইডি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশে এনআইডি প্রাপ্ত নাগরিকের সংখ্যা ১২ কোটির কাছাকাছি। এনআইডিতে দেওয়া সকল তথ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে কি না, তা ভোটাররা আজও জানতে পারেননি। তথ্য হালনাগাদের কোনো ঘোষণাও দেওয়া হয়নি। প্রথমদিকে ২১ ধরনের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে লেখা হয়েছে কি না, তা জানার সুযোগ নেই। ২০১২ সাল থেকে এ বিষয়ে তথ্যের সংখ্যা আরও বেড়ে ৪১-এ পৌঁছায়। বর্তমানে ভোটারদের কাছ থেকে ৪৬ ধরনের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। ছাত্র থাকার সময় যারা এনআইডি নিয়েছেন সময়ের ব্যবধানে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বৈবাহিক অবস্থা, পেশা এসব পাল্টে যাওয়ার কথা। অনেকের বাবা-মায়ের মৃত্যু হয়েছে, ঠিকানা বদল হয়েছে। বেশিরভাগ নাগরিকই এসব তথ্য হালনাগাদ করার সুযোগ পাননি। কোনো ধরনের তদবির বা যোগাযোগ না থাকলে এনআইডি সংক্রান্ত যে কোনো আবেদন পড়ে থাকে ইসি সচিবালয়ে। ফলে, সেবা পাওয়া তো দূরের কথা, সংশোধনের সঙ্গে সংযুক্ত মূল এনআইডিও ফেরত পান না ভুক্তভোগীরা। অনেকক্ষেত্রে সেই সংশোধন আবেদনে যুক্ত এনআইডির প্রয়োজন হলে বিপদ বাড়ে বহুগুণ। এ জন্য অনেকেই হারানো হিসেবে সরকারি কোষাগারে নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে আগের এনআইডি তুলতে হয়। যারা শিক্ষিত বা সনদধারী তাদের এনআইডিতে ভুল কম। অশিক্ষিত নাগরিকদের এনআইডিতে ভুল সবচেয়ে বেশি। কোভিড মহামারির কারণে অনলাইনে এনআইডি সংশোধনের ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছিল ইসি। অনলাইনে সংশোধন করেও বসে থাকতে হয় মাসের পর মাস।
এনআইডি বিভাগ যে মন্ত্রণালয়ের অধীনেই থাকুক, তাতে নাগরিকদের কিছু যায় আসে না। নাগরিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এনআইডি সেবা। তথ্য হালনাগাদ ছাড়াও সদ্য প্রাপ্তবয়স্কদের এনআইডি পাওয়া জরুরি। অনেকের এনআইডি এখনো স্মার্টকার্ডে রূপান্তর হয়নি। কিভাবে, কবে এটি রূপান্তর হবে কোনো নাগরিকের কাছে এই তথ্য নেই। কেউ ইচ্ছা করলে এই তথ্য জানতেও পারবে না। নাগরিকের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি কারণে একটি যোগাযোগবিহীন হিমঘরে রেখে দেওয়া হয়েছে, এই প্রশ্নের জবাব মেলে না। এনআইডি ছাড়া কোনো রাষ্ট্রীয় সেবা মিলবে না, আবার এনআইডি সেবাও নিশ্চিত করা হবে না; এটি সরকারের বিপরীতমুখী নীতি। হাত-পা বেঁধে পুকুরে সাঁতার কাটার জন্য নামিয়ে দেওয়ার মতোই বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সরকার যেমন সব ক্ষেত্রে এনআইডির ব্যবহার আবশ্যক করেছে, তেমনি এর সেবাও মানুষের হাতের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এনআইডির কোনো সমস্যা নিয়ে মানুষকে যাতে এক দিনও ভোগান্তিতে থাকতে না হয়, সেই নিশ্চয়তা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নিশ্চিত করতে হবে।
এতদিন বলা হয়েছে, সরকারের দুই বিভাগের সঙ্গে টানাপোড়েনের কারণে এনআইডি সেবা বিঘ্নিত হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সময় নষ্ট না করে বিষয়টি মীমাংসা করে দিয়েছে। এখন এনআইডি সেবার একক কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন। নাগরিকদের জন্য দ্রুত এনআইডি সেবা নিশ্চিত করতে তারা নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ ছাড়া বর্তমান সরকার রাষ্ট্রের নানা বিভাগ সংস্কার করছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সেবার সব ক্ষেত্রে কিভাবে নাগরিকদের শতভাগ সেবা নিশ্চিত করা যায়, এ নিয়েও একটি সংস্কার কমিশন গঠন করা যায়। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এই সেবা পেতে যাতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয়, এটি নিশ্চিত করা উচিত। এ জন্য এনআইডি সেবায় ‘ওয়ান স্টপ সেন্টার’ চালুর দাবি সকলের। কমিশন গঠন না করলেও এনআইডি সেবা নিয়ে বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে পারে। কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কি কারণে এনআইডির ক্ষেত্রে নাগরিক সেবা নিশ্চিত হচ্ছে না তা খুঁজে দেখতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করলে অবশ্যই এই সেবা নিশ্চিত হতে পারে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, জনকণ্ঠ
এনআইডি সেবা নিশ্চিত করা জরুরি
শীর্ষ সংবাদ: