পুরনো সংস্কৃতি ও সভ্যতাজুড়ে হাজার হাজার বছর ধরে চায়ের ইতিহাস বিদ্যমান রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতাব্দীতে চীনাদের হাত ধরেই 'চা' পর্যায়ক্রমে 'তিক্ত উদ্ভিজ্জ' বা 'ঔষধি উদ্ভিজ্জ' এবং চাইনীজ ভাষায় 'তু' হিসেবে জনপ্রিয় পানীয় হয়ে উঠে। ইংরেজ ও ওলন্দাজ বণিকেরা সপ্তাদশ শতকের প্রথম দিকে চীন থেকে চা আমদানি করত। দফায় দফায় চীন ও জাপানের যুদ্ধ চলতে লাগলে একসময় চা আমদানি বন্ধ হয়ে যায় এবং ইংরেজরা এর বিকল্প হিসেবে ভারতবর্ষকে চা উৎপাদনের উৎস হিসেবে বেছে নেয়। ১৮৪০ সালের দিকে ‘রয়েল সোসাইটি’ কমিশন পরীক্ষা করে সিলেট, কাছাড় জেলা ও আসামের লখিমপুরে চা-এর উৎপাদনে ব্যাপক বিস্তৃতি দেখতে পান।
'চা' এমন একটি শিল্প যার দ্রুতবর্ধনশীলতার কারণে প্রচুর শ্রম ও শ্রমিকের দরকার হয়। ইংরেজরা এই শ্রমিকের যোগান দেওয়ার জন্য সেসময় 'গাছ হিলায়ে গা তো পাইসা মিলেগা' (গাছ নাড়লে টাকা মিলবে) এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, কানু ও তেলেগুসহ প্রায় ১১৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে। কম মুনাফায় অধিক লাভের এই চক্রে পরে যায় নিরীহ জনগোষ্ঠী, তাদের একদিকে যেমন পাহাড়ে-জঙ্গলে হিংস্র পশুর থেকে বাঁচতে হতো, অন্যদিকে অনাহারে-অসুখে জীবন একেবারে জর্জরিত ছিল। সেসময় আড় প্রথা চালু ছিল, সে সুযোগে চা ম্যানেজাররাও একচ্ছত্র নির্যাতনের সুযোগ পেত। কেউ কাজ করতে না চাইলে কিংবা পালিয়ে গেলে তার জন্য দন্ডনীয় শাস্তি বরাদ্দ ছিল এমনকি চা-বাগানে শ্রমিকের মৃত্যু ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনারই অংশ।
উনিশ শতকেরই মাঝামাঝিতে বিট্রিশেরা শ্রমিক পাঠানোর গতি ত্বরান্বিত করার জন্য 'ফ্রি কনট্রাক্টরস' পদ্ধতি চালু করেছিল যা ছিল এক মহা ষড়যন্ত্র! কৃষিজ ফসলের উপর উচ্চ কর আরোপ করা হল এবং আড়কাঠিরা (স্থানীয় জনবল) গরীবদের সহজ সরল ছেলেমেয়েদের লোভ দেখিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে 'কুলি' হিসেবে জাহাজের ডিপোয় তুলে দিত। যেখানে আসনসংখ্যার ১০গুণ শ্রমিক কে জায়গা দেওয়া হত, ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে টিকে থাকার লড়াই শুরু হওয়ার আগে অনেক শ্রমিকই মারা যেত।
বিট্রিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনেই বেশিরভাগ চা-বাগানগুলো ছিল। পরবর্তীতে ভারতবর্ষজুড়ে বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে, চা- শ্রমিকেরাও কিছুটা 'আশার আলো' খুঁজতে থাকেন। ১৯২০ সালের দিকে শ্রমিকেরা বিদেশী মালিকদের বাণিজ্য ও চা-বাগান বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাগান থেকে দলে দলে বেরিয়ে পড়তে শুরু করেন। ১৯২১ সালে রাজনৈতিক আন্দোলন ও চা-শ্রমিকদের শোষণ বিরোধী আন্দোলন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সিলেট ও কাছাড়ের প্রায় ৩০,০০০ শ্রমিক 'চরগোলা এক্সোডাস' আন্দোলনে অংশ নিলাশোষিত চা-শ্রমিকেরা আসামের চরগোলা ও লঙ্গাই উপত্যাকা থেকে বেরিয়ে নিজ আবাসে (মুন্নুকে) ফেরত যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিল। যা ইতিহাসে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত এক ঘটনা হিসেবে রয়ে গেছে "মুল্লুকে চলো আন্দোলন"।
সেই কবেই ব্রিটিশ আমলের শেষ হয়েছিল। তবে চা-বাগানে শ্রমিকদের উপরে হওয়া নিপীড়ন কী বন্ধ হয়েছে? স্বাধীনতার ৫৩বছরে আমরা পা' দিয়েছি কিন্তু সেই স্বাধীনতা কী চা-শ্রমিকেরা ভোগ করছেন? এসব প্রশ্ন জাতির সুশীল নাগরিকদের ভাবানো উচিত।বাংলাদেশের প্রায় ২৫০ টি চা বাগানের ৯০ শতাংশ রয়েছে সিলেট বিভাগে। তাছাড়া চট্টগ্রামে ও বর্তমানে পঞ্চগড় জেলায়ও কিছু চা ফ্যাক্টরি রয়েছে। ২০২৩ সালের আগষ্ট অবধি, একজন চা শ্রমিকের দিনমজুরী ছিল ১২০ টাকা, চা শ্রমিকের বিক্ষোভের মুখে তৎকালীন সরকার তা বাড়িয়ে ১৭০টাকা করে দেয়। ২০২১ সালের তথ্যনুযায়ী, নিবন্ধিত চা-শ্রমিকের সংখ্যা এক লক্ষ তিন হাজারের বেশি এবং অস্থায়ী চা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাইত্রিশ হাজার। বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিকেরা 'প্রভিডেন্ট ফান্ড', রেশন, চিকিৎসা সেবা ও বেতনসহ ছুটি পেলেও অস্থায়ী শ্রমিকেরা তার কিছুই পান না। এ যেন বৈষম্যের মধ্যে আবার 'বৈষম্যে'!
চা-শ্রমিকের অধিকাংশই নারী। অথচ বেশিরভাগ চা-বাগানেই তাদের জন্য কোন বিশেষ সুবিধা নাই। তাদের টয়লেট থাকেনা, সময়বিশেষ ঠিকমত খাবার-পানিও সরবরাহ করা হয় না। নারী শ্রমিক অনিতা ভক্তি তার শিশুর অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে পেটের ক্ষুধা নিবারণ হয় না সেখানে ব্যাগ টেনে ভোরে বিদ্যালয়ে প্রবেশ না করে, খাঁচি কাধে চা-বাগানে প্রবেশ করতে হয়! হাতে গোনা কয়েকটি দ্বিদ্যালয় রয়েছে, তাতেও নেই শিক্ষক! এসব চা-বাগান গুলোতে কলেজের কোন ব্যবস্থাই নেই।
পুরো সিলেটের চা-বাগানগুলো জুড়ে, সন্ধ্যা থেকে রাত নেমে এলেই মাদক সেবনকে ঘিরে আরো এক অন্যতম রমরমা উদযাপন চলে বলা যায়! এই প্রথা বিট্রিশরাই চালু করে দিয়ে গেছিল, ঘরের পুরুষেরা দেশীয় মটের পাট্টায় হাড়িয়া-চোলাই মদের ব্যবসা করে এবং এগুলো সেবন করে ঘরে-বাইরে অশান্তি করে। যেহুতু সিলেট অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট, এখানে প্রচুর রিসোর্ট ও হোটেল আছে। অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত ট্যুরিস্টদেরও মাঝেমধ্যে এসব কর্মকান্ডের শিকার হয়ে অনিরাপত্তায় ভুগতে দেখা যায়।
শ্রম অনুযায়ী, 'চা শ্রমিকেরা এখনো কেবলমাত্র জাতীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন করতে পারেন'। অন্যান্য পেশার শ্রমিকদের মত তাদেরও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একাধিক ইউনিয়ন থাকা উচিত। তাদের বহুমুখী সমস্যা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের গতি সেক্ষেত্রে ত্বরান্বিত হবে। চা শ্রমিকেরা কল্যাণ তহবিলের কোন লভ্যাংশ পান না। স্থায়ী শ্রমিকদের এর অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে।অস্থায়ী শ্রমিকদের নির্দিষ্ট সময় কাজ করার ভিত্তিতে স্থায়ী শ্রমিকে নিবন্ধিত করতে হবে।
বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ মোতাবেক, চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে স্বাক্ষরিত আলোচনায়, অসুস্থতার ছুটি, গ্যাচুইটিসহ বীমার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা ছিল। আজও অনেক আদিবাসী চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর নিজের কোন আবাসস্থল নাই।
বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক 'চা শিল্পের উন্নয়নে পথ নকশা' নামক প্রকল্পে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। তাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তাতে ১৫ হাজার ইউনিট শ্রমিক বাসস্থান ইউনিট, শৌচাগার স্থাপন, মাদ্রাসা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ সহ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা আরোপণের বিভিন্ন নীতিমালা ছিল। ২০১৮ সালে, 'সুপেয় নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন শীর্ষক' আরও একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। যার ব্যয় ছিল ৬১ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা। এতসব কর্মসূচি নিলেও, চা শ্রমিকের সন্তানদের শিশুশ্রম বন্ধ হয় নি তেমন একটা, সোস্যাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট এন্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) বলছে, "চা-শ্রমিকের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। এখনো চা শ্রমিকেরা বাংলাদেশের সব চাইতে অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিত ও শোষিত গোষ্ঠী"।
শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। সিলেট জেলা শহরের হিসেবে ১৯.৩% শিশু শ্রমিক চা বাগানে রয়েছে। চা বাগানে প্রতি ২৫ শিশুর জন্য একটা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল মালিকদের। অথচ এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৪-১৫ টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩ টি। নেই কোন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে, একজন শিশুর শিক্ষাবাবদ মাসিক ৪৫ টাকা ব্যয় করা হয় যা খুবই নগণ্য! চা-শ্রমিক সন্তানের শিক্ষাবাবদ আরো অনেক বেশি পরিমাণে ব্যয় করতে হবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে যাতে করে এই শিশুদের জীবন তাদের বাবা-মার মত না হয়।
যুবসমাজকে মাদক থেকে রক্ষা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইন প্রণয়নেই শুধু মুখ্য ভূমিকা পালন করলে হবে না, এর সুশাসনও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এইসব অঞ্চলে দেখা যায়, পুলিশ ও আইনের লোকেরা মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে যথেষ্ট পরিমান কমিশন পেয়ে তাদের ব্যবসা বাধা হয়ে দাড়ান না।
চা 'কুলি' থেকে চা 'শ্রমিক' হল তারা, কিন্তু জীবন তাদের কেটে ফেলা চা পাতা গাছের মতই রয়ে গেল। এই দুষ্টচক্র থেকে তাদের বের হওয়া যেন কোনমতেই সম্ভব হচ্ছেনা। শ্রম বিভাগের এই শ্রমিকদের প্রতি সরকারের বিশেষ দেখভালের দরকার রয়েছে। এর সাথে গবেষণা, গণমাধ্যম, বিভিন্ন জাতীয় সেমিনার ও সভাতে আমরা চা শ্রমিকের জীবন ব্যবস্থাকে মেইনস্ট্রিম সমস্যা হিসেবে নিয়ে আসতে পারি যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়