ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

ভূমিকম্প মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি জরুরি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২১:১৫, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

ভূমিকম্প মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি জরুরি

চলমান জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে চারদিনের ব্যবধানে দেশে মাঝারি ও তীব্র ধরনের দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে ভূমিকম্প দুটির উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের বাইরে। ভূমিকম্পগুলোতে বাংলাদেশের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি পরিলক্ষিত না হলেও এতে দেশবাসীর হৃদয়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপত্তিস্থল দেশের বাইরে হলেও দেশে দুইবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার ঘটনা দেশকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাপক ভূমিকম্পের ঝুঁকির মুখোমুখি। এখানকার ঘনবসতি, পুরনো আবকাঠামো এবং বিল্ডিং কোডের দুর্বল প্রয়োগ এই বিপদগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অবিলম্বে পর্যাপ্ত কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্পের আঘাত উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। ২০২৪ সালে রেকর্ড করা ৬০টি ভূমিকম্পের মধ্যে তিনটি ৪ মাত্রার ওপরে এবং ৩১টি ছিল ৩ থেকে ৪ মাত্রার মধ্যে।  
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে রাজউক-সিডিএ ও বিভিন্ন জেলা উপজেলায় সংশ্লিষ্ট সেবা খাতসমূহ অর্থবহ নগর-জনপদ পরিকল্পনায় প্রায় ব্যর্থ বলেই জনশ্রুতি রয়েছে। বিগত সরকার আমলে কতিপয় অর্থলিপ্সু মানবরূপী হিংস্র দানবদের ন্যূনতম বিবেক বিকশিত না করে শুধু ব্যক্তিস্বার্থে নদী-নালা-খাল-বিল-জলাশয় ভরাটে ভবন নির্মাণের অনুমতি প্রদানে এক বিপর্যস্ত পরিবেশ রচিত হয়। সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য ব্যক্তিদের অযৌক্তি-অনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিয়ে দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়ভাগ কে নেবে, তা সুস্পষ্ট নয়। এ ধরনের অপকর্মে জড়িত সামান্য বেতনের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিশাল সম্পদের অধিকারী হওয়ার বিষয়টিও গোচরীভূত। অধিকাংশ পর্যায়ে সামন্যতম ভবন নির্মাণ কোড-বিধিমালা না মেনেই শুধু কর্মকর্তাদের অর্থলোভের কারণে দেশজুড়ে দুর্বল ভবন নির্মাণের প্রভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ-নানামুখী আর্থ-সামাজিক কঠিন অসংগতি অচিরেই দেশকে কোন্ পর্যায়ে পৌঁছে দেবে তা কল্পনায়ও আনা যাচ্ছে না। ব-দ্বীপ খ্যাত বাংলাদেশ ভূমিকম্পের প্রচণ্ড ঝুঁকিতে থাকা সত্ত্বেও অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কোনো ধরনের চিন্তাচেতনা বা কর্মব্যবস্থাপনার কৌশল গ্রহণ দৃশ্যমান নয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায় বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব  অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জায়গায় যে ফল্ট লাইন রয়েছে, সেখানে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড তিন মিটার এবং মিয়ানমারের একটি দ্বীপ ছয় মিটার ওপরে ওঠে আসে। একই ভূমিকম্পে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে কঠিন শিলা ভেদ করে নিচ থেকে কাদা বালুর উদ্গিরণ ও বঙ্গোপসাগরে সুনামির দৃষ্টান্তও রয়েছে। এই সুনামির কারণে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে বাড়িঘর ভেসে গিয়ে প্রায় ৫০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বেঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত ১৮৮৫ সালের মধুপুর ফল্টের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক শূন্য। এটি এত শক্তিশালী ছিল যে ভারতের সিকিম, বিহার, মনিপুর এবং মিয়ানমারেও অনুভূত হয়েছিল। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন মেঘালয়ের শিলংয়ের কাছে যে মারাত্মক ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল, তার ফলে বাংলাদেশের ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ অনেক শহরের দালান কোঠা ভেঙে পড়ে ও অনেক লোক প্রাণ হারায়। ২১ নভেম্বর ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় প্রচণ্ড ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং অনুরূপভাবে ১৯৯৯ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে মহেশখালী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায় চার দফা ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। যার ফলে, এই সব এলাকায় বহু লোকের মৃত্যুবরণের পাশাপাশি বাড়ি-ঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে ১০ বার, ১৯৯৯ সালে ২১ বার, ২০০০ সালে এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৪ বার ভূকম্পন হয়েছে।   
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে ইরানের বাম শহরের কাছাকাছি ২০০৩ সালে ৬ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং বহু মানুষ আহত হয়েছিল। ২০০৮ সালে ওয়েনচুয়ান ভূমিকম্পে ৯০ হাজার মানুষের হতাহতের পাশাপাশি প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছিল। ১৯৫০ সালে তিব্বতে সংঘটিত ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় জাপানে সবচেয়ে বেশি ভূকম্পন রেকর্ড করা হয়। ২০১১ সালে হওয়া টোকিও ভূমিকম্পে হতাহতের চেয়ে এর ফলে সৃষ্ট সুনামিতে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। জাপানের মতো ইন্দোনেশিয়া, ফিজি এবং টঙ্গায় প্রতিবছরই ছোট ছোট ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়। ২০১৪ সালে সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড তৈরি করে ইতিহাসের বৃহত্তম সুনামির জন্ম দেয়। সেই সুনামিতে দুই লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৯৫৫ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল ঐ অঞ্চলের জন্য রেকর্ড।  
এছাড়াও ২০১৬ সালে ইতালির অ্যামাট্রিসা শহরে মাঝারি মাত্রার তিন দফা ভূমিকম্পে তিন শতের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে আলাস্কায় আঘাত করেছিল ৯ দশমিক ২ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প। দক্ষিণ আমেরিকান প্লেটের সঙ্গে কয়েকটি মহাদেশীয় প্লেটের সংঘর্ষের কারণে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয় প্রায়ই শক্তিশালী ভূমিকম্প দেখা যায়। বিশেষ করে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলার ক্যারাবিয়ান উপকূলে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬০ সালে। সেই সময় চিলে সালভেদরের কাছে ৯ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছিল ২০ লাখের বেশি মানুষ। পরবর্তীতে ২০১০ সালে কনসেপসিওন শহরের কাছে আরেকটি ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয়েছিল প্রায় ৫০০ মানুষ। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি মুসলিমপ্রধান দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের ভয়াবহতার অভাবনীয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যপট বিশ্বজুড়ে সমগ্র মানবহৃদয়কে করেছে ক্ষতবিক্ষত। শুধু অর্ধলক্ষাধিক প্রাণহানি নয়, হাজার হাজার নাগরিকের হতাহত ও বিধ্বস্ত সভ্যতার নির্দয় ধ্বংসস্তূপ বিশ্ববিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচ্য এই ভূমিকম্পে বিস্তীর্ণ এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে তুরস্ক ও সিরিয়া মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল।
বাংলাদেশের ভূতত্ত্ববিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এখানকার ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি তুরস্কের মতো বা তার চেয়ে বেশি মাত্রায় হতে পারে। আর এই ক্ষয়ক্ষতির পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হবে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা ভবন-নগরায়ণ। জাতিসংঘের ভাষ্যমতে, পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ২০০৯ সালে পরিচালিত সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে ঢাকায় সাত বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়ার, ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত এবং আনুমানিক সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টারের জরিপে দেখা যায়, রাজউকের আওতাধীন ১ হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ২ লাখ ৪ হাজার ১০৬টি ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯২৫টি ভবন অর্থাৎ ৬৬ দশমিক ১ শতাংশই অনুমোদনহীন। ঢাকায় সাতের বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ এবং শুধু ইটের তৈরি ভবনগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। তাছাড়া বালু দিয়ে জলাশয় ভরাট করে তৈরি ভবনগুলোও ঝুঁকিতে থাকবে। জলাশয়ের ওপর করা ভবনগুলোর নিচের মাটি শক্ত না হওয়ার কারণে ঝাঁকুনি এলে সয়েল লিকুইফিকেশন ইফেক্টের প্রভাবে ভবন দেবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সার্বিক বিবেচনায় কালক্ষেপণ না করে কোনো ধরনের অনৈতিক লেনদেনে বা অবাঞ্ছিত পৃষ্ঠপোষকতায়-মাফিয়াচক্রের যোগসাজশে নির্মাণ দুর্নীতি রুখে দেওয়া না হলে দেশের জন্য চরম অসহায় ভবিষ্যৎ মুখিয়ে থাকবে। অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় চৌকস-দক্ষ- যোগ্য দেশপ্রেমিক তদন্ত দলের মাধ্যমে ইতোমধ্যে অত্যন্ত অগোছালোভাবে নির্মিত ভবনসমূহের দুর্বলতা আবিষ্কারসহ উচ্ছেদে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দেশকে নিষ্ঠুর পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। তাৎপর্যপূর্ণ সমন্বয় ব্যতিরেকে সংস্থাসমূহের পক্ষ থেকে শুধু বাচনিক ভঙ্গিতে একে অপরের প্রতি অঙ্গুলি প্রদর্শন-দোষারোপের অপসংস্কৃতি পরিহার করে প্রায়োগিক কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। অভিযুক্ত অপরাধীদের সতর্কতামূলক পত্র-কর্মচ্যুতি নয়; তাদের অবৈধ উপার্জিত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিয়ে জনকল্যাণে ব্যয় করাই হবে উৎকৃষ্ট পন্থা। দ্রুততর সময়ের মধ্যে উল্লেখ্য, অপকর্মের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের জোরালো দাবি।  
 
লেখক : শিক্ষাবিদ

×