একজন শিক্ষার্থী তার সুন্দর ও গোছানো জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে তার পরিকল্পিত পড়াশোনা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে নির্দিষ্ট কিছু ধাপ পেরিয়ে ভর্তি পরীক্ষা নামক এক নির্বাচনমূলক যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়ে থাকে। সাধারণত তিনটি বিভাগের মধ্যে হয়ে থাকে এই সংগ্রাম (বিজ্ঞান বিভাগ, মানবিক বিভাগ, ব্যবসায়ী বিভাগ)। ভর্তি যুদ্ধ যা ডারউইন এর নেচারাল সিলেকশন থিওরি এর প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতিতে যেনো যোগ্য ও শক্তিশালীরাই টিকে থাকে আর দূর্বলরাই ঝড়ে পড়ে। আসলেই কি তাই?
বাংলাদেশে ভর্তি পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে মূল কারণগুলো হলো-
চরম মানসিক চাপ: ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর পরিবারের, সমাজের এবং কখনও কখনও নিজের পক্ষ থেকেও প্রচÐ চাপ থাকে। যা মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হতাশার দিকে ঠেলে দেয়।
অত্যধিক প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশে ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। অপরদিকে আসন সংখ্যা সীমিত। এই প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়ে দেয়, যেন তাদের সামান্য ভুলও জীবনের বড় ক্ষতি করতে পারে।
পরিবার এবং সমাজের প্রত্যাশা: পরিবার এবং সমাজ থেকে উচ্চ প্রত্যাশা অনেক সময় শিক্ষার্থীদের মনে একধরনের ব্যর্থতার ভয় সৃষ্টি করে। এই পরীক্ষায় সফল না হওয়ার আশঙ্কা তাদের মনে এই ধারণা তৈরি করে যে তারা পরিবার বা সমাজের চোখে অযোগ্য হয়ে যাবে।
ব্যর্থতার ভয়: অনেক শিক্ষার্থী মনে করে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো না করতে পারলে তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। যা তার হতাশা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব বাড়িয়ে দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অভাব: বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা এবং সঠিক সেবা পাওয়ার সুযোগ এখনো সীমিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাদের হতাশা বা উদ্বেগ নিয়ে কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারে না।
৬. প্রস্তুতির সময় এবং চাপ: ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়টুকুতে অনেক শিক্ষার্থী একা থাকে, ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটি তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলে।
সা¤প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যার মধ্যে ৩.৫% পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে এই পথ বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থতার কারণে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। দেশের স্বনামধন্য কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশÑ
১. নোহা (১৮)
* স্থান: সাভার, ঢাকা, বাংলাদেশ।
* তারিখ: ১৬ জানুয়ারি ২০২২।
* বিবরণ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে নোহা নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
২. পিউ কর্মকার (২০)
* স্থান: পাবনা সদর, বাংলাদেশ।
* তারিখ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩।
* বিবরণ: বারবার ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়ে পিউ কর্মকার পদ্মা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
৩. স¤প্রতি ২০২৫, জানুয়ারি মাসে, রেটিনা পরিবারের সম্ভাবনাময়ী ছাত্রী "আফ্রিদা চৌধুরী মুনা" (রেটিনা রোল: ৫৫১৫৩০) স্ট্রোক জনিত কারণে ইন্তেকাল করেছেন।
এ ধরনের ঘটনা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক প্রত্যাশার চাপের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে পরীক্ষায় ব্যর্থতা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের উচিত শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সমর্থন প্রদান করা। যাতে তারা চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় এবং হতাশা থেকে মুক্ত থাকে।
সমাধানের উপায়:
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবার, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা: ভর্তি পরীক্ষার সিস্টেমে সংস্কার আনা এবং শিক্ষার্থীদের বিকল্প শিক্ষার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
পরিবারের সমর্থন: পরিবারকে বুঝতে হবে যে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বেশি।
মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্যতা: মানসিক চাপের সময়ে শিক্ষার্থীরা যেন পরামর্শ ও সঠিক সহায়তা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমানো এবং আত্মহত্যার হার কমানো সম্ভব।
শিক্ষর্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়