একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয়, যখন এর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলতে সাধারণত সেইসব মানুষকে বোঝানো হয়, যারা দারিদ্র্য, শিক্ষা ও সুযোগের অভাবে সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। এদের মধ্যে রয়েছে দরিদ্র কৃষক, ভূমিহীন শ্রমিক, বস্তিবাসী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং শারীরিক কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধিতায় ভুগতে থাকা মানুষ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাদের জীবনমান উন্নয়ন শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে প্রথমেই যা প্রয়োজন, তা হলো মৌলিক চাহিদা পূরণ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক বিষয়গুলো এখনও অনেকের জন্য অধরাই থেকে গেছে। অধিকাংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দিনমজুরি বা ক্ষুদ্র কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তাদের আয়ের সীমাবদ্ধতা তাদের জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত কষ্টকর করে তোলে। সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা এবং সুলভ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি তাদের দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।
শিক্ষার অভাব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। এখনও অনেক শিশু স্কুলের বদলে কাজের জন্য ঝুঁকে পড়ে। এর ফলে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং তারা দরিদ্রতার চক্র থেকে বের হতে পারে না। প্রান্তিক শিশুদের জন্য স্কুলে ভর্তি সহজ করা, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ এবং মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করলে তাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়বে। একই সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো গেলে পরিবারের সামগ্রিক জীবনমান উন্নত হবে।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে অবহেলিত। বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায় না। সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে প্রত্যন্ত এলাকায় আরও ক্লিনিক স্থাপন, ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। মাতৃ ও শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাদের জন্য দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা দিলে তারা নিজেদের আয়ের উৎস সৃষ্টি করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, গার্মেন্টস, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, কিংবা কুটির শিল্পের মতো খাতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে।
নারীদের ভূমিকা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেক প্রান্তিক নারী এখনও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন। তাদের জন্য উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ এবং কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা হলে পরিবারের আয়ের মান বাড়বে। একই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। সমাজের সকল স্তরে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সম্মানজনক আচরণ গড়ে তোলা প্রয়োজন। গণমাধ্যমের মাধ্যমে তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরা এবং এ বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিলে জনসচেতনতা বাড়বে।
অবশেষে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতি নয়; বরং এটি মানবিক মূল্যবোধ, সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন করতে পারলে আমরা একটি টেকসই, ন্যায্য এবং সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
শিক্ষার্থী: ঢাকা কলেজ, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৮০৬৭১১৯৩
ই-মেইল : [email protected]