ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

টেকসই উন্নয়ন কেন জরুরি

মোঃ আলামিন আলী

প্রকাশিত: ১৭:০৮, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫

টেকসই উন্নয়ন কেন জরুরি

বিশ্ব প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আধুনিকতার এই যাত্রায় মানবজাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করলেও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব এখন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অতি ব্যবহার আমাদের চারপাশের পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসবের পরিণতিতে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য সংকট এবং বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলো দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে টেকসই উন্নয়ন একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
টেকসই উন্নয়ন বলতে এমন উন্নয়নকে বোঝায়, যা বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনীয়তা পূরণের ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখে। এটি পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সমাজ—এই তিনটি প্রধান ক্ষেত্রকে একত্রিত করে একটি ভারসাম্যমূলক উন্নয়নের পথ তৈরি করে। বর্তমান সময়ে পরিবেশের ওপর মানুষের কর্মকাণ্ডের বিরূপ প্রভাব এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়ন কেবল একটি পছন্দ নয়, বরং প্রয়োজন।
টেকসই উন্নয়ন পরিবেশের সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, বৃক্ষনিধন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এছাড়া দূষণ, বিশেষ করে বায়ু এবং পানিদূষণ, মানবজীবন ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও টেকসই উন্নয়ন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বর্তমান বিশ্বে সম্পদের বণ্টনে বৈষম্য একটি বড় সমস্যা। কিছু দেশ এবং জনগোষ্ঠী অতিরিক্ত সম্পদ ভোগ করছে, অন্যদিকে অনেকেই মৌলিক চাহিদা পূরণে অপারগ। টেকসই উন্নয়ন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে, যা ন্যায্য সম্পদ বণ্টন নিশ্চিত করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করে।
সামাজিক দিক থেকেও টেকসই উন্নয়ন অপরিহার্য। এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং মৌলিক মানবাধিকারের উপর গুরুত্ব দিয়ে একটি ন্যায্য সমাজ গড়ে তোলে। উন্নয়ন তখনই সফল, যখন তা সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জন্য উপকার বয়ে আনে। লিঙ্গ সমতা, শিশুদের সুরক্ষা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন টেকসই উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়ন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক, এবং এখানকার বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদনে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, খরা এবং নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এছাড়া শহরাঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব পরিবেশকে দূষিত করছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে পরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ু সহনশীল কৃষি এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝউএ) বাস্তবায়নে জাতিসংঘের উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো পরিবেশের সুরক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, মানসম্মত শিক্ষা এবং লিঙ্গসমতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশও এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো, সবুজ অর্থনীতির প্রসার এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করার মাধ্যমে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, টেকসই উন্নয়ন শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্য একান্ত জরুরি। এটি বর্তমানের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়। ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সরকারি স্তরে সচেতনতা এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও, সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব।
শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

×