.
গুয়াহাটি তাঁর শহর হলেও এর আকাশে-বাতাসে সারাক্ষণ ওই দরাজ কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয় না। তবু কোনো এক শীত সন্ধ্যায় সে শহরে পা রেখে মনে হয়েছিল এখানেই আছেন তিনি। এই শহর, শহর পেরিয়ে গাঁ, তারপর উঁচু-নিচু পথ ধরে কাজীরাঙা অভয়ারণ্য, কামরূপ-কামাক্ষা তীর্থ অথবা শেষ সূর্যের আলোয় বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র সবখানে আছেন তিনি। আসলে তো তিনি ছিলেন আমাদের মনে। তাই অসমের যেখানে গিয়েছি, মনে হয়েছে এ দেশ ভূপেন হাজারিকার। তাঁর সুর বেজেছে অন্তরে। যৌবনে সেই যে বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন গানে গানে তার রেশ রয়েছে প্রায় সবটুকু। এখনো ঘরোয়া গানের আসরে তাঁর সুর আমাদের অবলম্বন। এখনো প্রতিধ্বনি শুনি ‘মোর গাঁয়েরও সীমানায় পাহাড়ের ওপারে নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি।’ পৃথিবী বদলেছে। বদলেছিলেন তিনিও। তাতে তাঁর গানের প্রতি ভালোবাসায় আঁচ লাগেনি একটুও।
ছিয়াশি বছরের জীবনের শেষ দিকে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ভক্তদের বড় এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন। তাহলে ভূপেন হাজারিকাও? ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল’ ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি রতনপুর বাগিচায়’ ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা’ ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’ ‘ও-মালিক সারাজীবন কাঁদালে আমায় এবার মেঘ করে দাও’ ‘বিস্তীর্ণ দুপারের সহস্র মানুষের হাহাকার শুনে ও-গঙ্গা তুমি বইছ কেন’ এসব গানের স্রষ্টা একেবারে বিজেপিতে! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে যদিও ফিরেছিলেন নিজস্ব ঘরানায়, অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তবু ভক্তরা কার্যকারণ মেলাতে পারেনি আজও। কেন এমন হয়? কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও মৃত্যুর আগে কংগ্রেসের দুয়ারে কড়া নেড়েছিলেন। সারাজীবন বিরুদ্ধ ¯্রােতে চলে হতাশার ক্লান্তিই কি এ উল্লœম্ফনের কারণ? নাকি ‘পরকাল’ ভীতি অথবা অন্য কিছু? যার প্রেমের গানেও আছে প্রতিবাদ, গতানুগতিকতার বাইরে বেরোনোর হাতছানি তিনি কিভাবে প্রতিবাদের ভাষা ভুলে ওরকম কাজ করতে পেরেছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়ের।
গণনাট্য সংঘের একগুচ্ছ মেধাবী ও প্রতিবাদী শিল্পীর মধ্যে ভূপেন হাজারিকা ও সলিল চৌধুরী ভারতীয় সংগীতের মূলধারায় থেকেও নিজেদের আদর্শ ও কমিটমেন্টের অনুগামী হতে পেরেছিলেন। সলিল চৌধুরী সাধারণ গাঁয়ের বধূর কথা বলতে গিয়ে তাকে অসাধারণ করে তোলেন। ভূপেন হাজারিকা চলচ্চিত্রে প্রেমের গানকেও অসাধারণ উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেন। সীমানা পেরিয়ের সেই গান ‘জল থৈ থৈ করে কেউ নেই তুমি আমি সব একাকার ... পুরনো সব নিয়ম ভাঙ্গে অনিয়মের ঝড়। ঝোড়ো হাওয়ায় ভেঙ্গে গেছে মিথ্যে তাসের ঘর ...।’ কান পাতলেই যেন গম গম করে ওঠে সেই কণ্ঠ। তাঁদের প্রতিবাদী গানগুলো তো নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ। ভূপেন হাজারিকার অসাধারণ শব্দ চয়ন তাঁর গানকে হৃদয়ের কাছে নিয়েছে। শব্দ চয়নে যেমন দক্ষ তিনি, তেমনি তাতে সুর দেওয়া ও পরিবেশন সব কাজের সমন্বয়ে নিখুঁত শিল্প সৃষ্টি করেছেন। কিছুটা চটুল ‘আমায় ভুল বুঝিস না মাইয়া’ অথবা ‘দাঁতে কাইটো না ঠোঁট আর বাঁকা চোখে চাইও না অনেক জ্বালাইছ কন্যা আর জ্বালাইও না’ এ ধরনের গানও অসাধারণ হয়ে ওঠে শুধু শব্দ চয়ন ও গায়কীর জন্য। গলায়ও কি এক অদ্ভুত মাদকতা। দরাজ কিন্তু মায়াবী। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে সচেতন।
গুয়াহাটির সিডির দোকানে আমরা যখন তাঁর অসমীয়া গানের সংগ্রহ খুঁজছি, তখনো জানতাম না তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বেশ কিছু চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন জানতাম, অভিনয়ের তথ্য জানা ছিল না। জানিয়েছিলেন বিক্রেতা। ‘একপাল’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। অসমীয়া চলচ্চিত্র ‘এরা বাতার সুর’-এ সুর দিয়ে চলচ্চিত্রে সংগীতকার হিসেবে পথচলা শুরু। মোট চৌদ্দটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন। একই সঙ্গে প্রযোজক, পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত শিল্পীর কাজ করেছেন। ১৯৭৫ সালে শ্রেষ্ঠ সুরকার ও শিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। চলচ্চিত্রের নাম ‘চামেলী মেম সাহেব’। সংগীত ও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর মধ্যে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকের মতো পুরস্কার রয়েছে। এসব তথ্য অবশ্য এত বিস্তৃত জানতেন না ওই বিক্রেতা। আমাদেরও তথ্যপ্রাপ্তির আরও ঘাটতি ছিল। যেমন বহুকাল ধরে জানতাম তিনি সংগীতে পিএইচডি করেছেন। পরে জেনেছি, তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল গণযোগাযোগ। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় পরিচয় হয় বিখ্যাত আমেরিকান গণসংগীত শিল্পী পল রবসনের সঙ্গে। রবসনের বিখ্যাত গান ‘ওল্ডম্যান রিভার’ এর আদলে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘বিস্তীর্ণ দুপারের সহস্র মানুষের হাহাকার শুনে ...’ গানটি। এর অসমীয়া সংস্করণও আছে। তার জনপ্রিয় গানগুলোর অসমীয়া বাংলা ও হিন্দি ভার্সন রয়েছে। ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায়ও গান করেছেন। বাংলায় গাওয়া ‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু ...’ গানটি বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় বাংলা গানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গান আর চলচ্চিত্র শুধু নয়, তাঁর দক্ষতা ছিল লেখালেখিতেও। অসমীয়া ভাষায় প্রথম সারির একজন কবি ও লেখক ছিলেন তিনি। প্রবন্ধ, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, কবিতা ও ছোটদের জন্য ছড়া লিখেছেন।
প্রচলিত অর্থে আত্মীয় বলতে যা বোঝায় ভূপেন হাজারিকা বাঙালি শ্রোতার তেমন কেউ ছিলেন না। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে কোথাও ভীষণ করুণ সুর বেজেছে। বুকের গভীরে শূন্য অনুভূতি হয়েছে। উপমহাদেশের প্রবীণ শিল্পীরা একে একে বিদায় নিচ্ছেন। বাঙালি না হয়েও ভূপেন হাজারিকার মতো এত চমৎকার বাংলা গান কম শিল্পীই গাইতে পেরেছেন। বাংলা ভাষা ও বাঙালির আবেগকে অনেক বাঙালির চেয়েও বেশি দরদ দিয়ে বুঝেছিলেন বলেই হয়তো তাঁর গান এতটা নাড়া দিতে পারে। রেডিওতে যখন তাঁর গান বাজত, অনেকেই ভাবতেন তিনি বাঙালি। অসমীয়া বর্ণমালা আর বাংলা বর্ণমালার মতো বাংলাদেশ ও অসমের একেবারে সংলগ্ন অবস্থানের জন্যও হয়তো তিনি বাংলার আবেগ এভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। বাংলা ভাগের ইতিহাস একটুখানি অন্যরকম হলে তিনি তো আমাদের আরও কাছের হতেন। মৃত্যুর পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী চলচ্চিত্রকার কল্পনা লাজমি বলেছিলেন, ‘ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন তিনি। আরেকজন ভূপেন হাজারিকা কখনো জন্মাবে না। তিনি শুধু গায়ক ছিলেন না, একজন মহান সমাজ সংস্কারক হিসেবেও কাজ করেছেন।’
ভারতীয় মিডিয়া তাঁর মৃত্যুর খবর একেবারেই সাধারণভাবে দিলেও সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করেছিল তাঁকে। মুম্বাই থেকে তাঁর মরদেহ অসমের লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলৈ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সাধারণ মানুষ আবেগাপ্লুত হয়ে ঘিরে রাখে তাঁকে। বিমানবন্দর থেকে ট্রাকে করে শিল্পীর বাড়ি পর্যন্ত তিরিশ কিলোমিটার পথের দুধারে দাঁড়িয়ে তাঁরই গান গেয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান তারা। ব্রহ্মপুত্রের সন্তান ভূপেন হাজারিকা শেষ আশ্রয় নেন ওই নদীর তীরেই। কেউ কেঁদে, কেউ চোখের পানি আড়াল করে শেষ বিদায় দেন শিল্পীকে। তাদের শোকে চারপাশের বাতাস ভারি হয়। যে বাতাসে ভেসে বেড়ায় তাঁর গান একদিন, প্রতিদিন চিরদিন। যতদিন ‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য’ ততদিন বেঁচে থাকবেন পৃথিবীর যাযাবর ভূপেন হাজারিকা, নিশ্চয়ই থাকবেন।