.
শ্রমের মর্যাদা বিষয়ে বিদ্যালয়ে রচনা লেখেনি এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শত বছর ধরে এ সংস্কৃতি চালু থাকলেও শ্রমের মর্যাদা, তথা শ্রমিকদের সম্মান সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি আজও। রবিবার রাজধানীতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘শ্রমিকের জীবনমান, কর্মপরিবেশ ও অধিকারসংক্রান্ত সংস্কার উদ্যোগ : অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বক্তাদের যেসব অভিমত উঠে এসেছে এর অনেকটা দেশের মানুষের জানা থাকলেও কিছু বিষয় বিস্ময় জাগানোর মতোই। এসবই নেতিবাচক বাস্তবতা এবং অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দেশের মোট শ্রমিকশ্রেণির ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় না। দেশের শ্রমিকরা সব মিলিয়ে ১৪২টি খাত ও উপখাতে কাজ করেন। এর মধ্যে পোশাক ও ট্যানারিসহ মাত্র ৪২টিতে ন্যূনতম মজুরির ঘোষণা আছে। অন্যদিকে হালকা প্রকৌশল, স্টিল রি রোলিং ও শিপ ব্রেকিংসহ ১০০ খাত-উপখাতে এখনো কোনো ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি। সেসব খাতের শ্রমিকের জন্য কোনো আইনি সুরক্ষাও নেই।
শ্রমিকশ্রেণির জীবনমান, কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকারবিষয়ক স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করা হয় সভায় পঠিত প্রবন্ধে। এসব সুপারিশ হলো- আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও পরিচালনগত; যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের। শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান জানান, ‘দেশে মোট শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে আট কোটি। আগে যেমন দাসত্ব ছিল, এখনো তা আছে। তবে এখন আছে নতুন ধরনের দাসত্ব।’ আমরা যদি নিজেদের সুসভ্য সমাজের নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করি, তবে অবশ্যই এই দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। শ্রমিকের জীবনযাপনের মান এবং সামাজিক সম্মানের বিষয়টি নিতে হবে বিবেচনায়। বছরের একটি দিন মে দিবস দেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়। সেদিন থাকে সরকারি ছুটিও। বাস্তবতা হলো, শ্রমিকদের উৎসব করার মতো অবস্থা নেই। সহজ করে বললে বলতে হবে, শ্রমিকের জীবন মানবেতর। অথচ কলে-কারখানায় তাদের শ্রমেই উৎপাদিত হয় বিচিত্র পণ্যসম্ভার, যা সমাজের বৃহত্তর মানুষের নিত্যব্যবহার্য। ধূপের মতো নিজে পুড়ে গন্ধ বিলানোর জীবন এক একজন শ্রমিকের। পুঁজিবাদী আধুনিক বিশে^ শ্রমিকরা অর্থকষ্টে থাকে না। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে ঝুঁকি হ্্রাস ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকে। কর্মক্ষেত্রে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে চার দেওয়ালের ভেতরে আটকে পড়ে তাদের অকালমৃত্যু ঘটে না। কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য তুই-তোকারি করে না। দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশের চিত্র একেবারে তার বিপরীত। অবস্থার পরিবর্তনের জন্য মানবিক মর্যাদা ও মানবাধিকার সচেতন হলেই যথেষ্ট। আমাদের মন মানসিকতার পরিবর্তনও চাই সবার আগে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে হকার, গৃহশ্রমিক ও দিনমজুরের জন্য সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। বাস্তবে প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য নিম্নতম মজুরির মানদণ্ড, সামাজিক সুরক্ষা ও সাংগঠনিক অধিকার থাকা জরুরি। তাহলে গতিশীল অর্থনীতিতে তাদের ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। শত খাতের ন্যূনতম শ্রমমজুরি যদি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্ধারণ করে যেতে পারে, সেটিও হবে শ্রমের মর্যাদা প্রশ্নে একটি বড় পদক্ষেপ।