ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ

প্রবাসে প্রজন্মের সুরক্ষা

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

প্রবাসে প্রজন্মের সুরক্ষা

মানুষ মানুষের জন্য। এই কথাটা আমরা সুযোগ পেলেই আওড়াই। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আসলে কি? প্রবাসে আছি অনেক বছর। সিডনি একটি বহুজাতিক মানুষের দেশ। হাতেগোনা দুই একটি দেশ বাদ দিলে প্রায় সব দেশের মানুষ থাকেন এখানে। এই যে বহুজাতিকতা এর ভালো দিক যেমনÑ সবাইকে চেনা বা পরিচিত হওয়া, তেমনি খারাপ দিকও আছে। বিশেষ করে অপরিচিত ভাষা-সংস্কৃতি আর খাবার, পোশাকের মানুষ চাইলেই একাত্মতা বোধ করতে পারে না। যে কারণে বিচ্ছিন্নতা এসব সমাজে সাংঘাতিক। এমন ভাবা অন্যায় যে আমরা নিজেরা নিজেরা থাকি বা নিজের সঙ্গে কথা বলি। সামাজিকতা অবশ্যই আছে। বাঙালির বাইরেও আমাদের আত্মীয়তুল্য এমন সব মানুষ আছেন, যারা বাংলা বুঝলেও বাংলায় কথা বলেন না। আবার এমন সুহৃদও আছেন, যারা বাংলার ব-ও জানেন না। কিন্তু তারা আমাদের আপদ-বিপদের বড় সহায়। তারপরও যে বিচ্ছিন্নতার কথা বলছি তার নাম নিঃসঙ্গতা।
এই নিঃসঙ্গতা এখন বিশ্বব্যাপী। আমাদের স্বদেশ একমুখী সমাজের দেশ। ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এক ভাষায় কথা বলেন। এক ধর্মের অনুসারী। একই সংস্কৃতি লালন করেন। তারপরও সমাজে নিঃসঙ্গতা বাড়ছে। মানুষ কতটা নিঃসঙ্গ তা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। সেটা আপনি তরুণ-তরুণীদের দিকে তাকালেই বুঝবেন। একেক জন এখন একেকটি নিঃসঙ্গ দ্বীপ। হাতের মোবাইল ছোট পর্দা আর বড় পর্দার কাছে অসহায় মানুষের বড় অংশই তরুণ-তরুণী। কৌশলগতভাবে অনেক এগিয়ে তারা। তাদের কাছে টেকনোলজি আঙুলের খেলা। আমার ছোট দুই নাতনি যাদের বয়স এখনো পাঁচ পেরোয়নি, তারা যেভাবে মোবাইল ব্যবহার জানে বা করে তা রীতিমতো আশ্চর্যের! এই প্রজন্ম বা ভাবীকালের মানুষ যন্ত্রনির্ভর প্রযুক্তিনির্ভর। সেটা দোষের কিছু নয়। দোষ বা ত্রুটি অন্যত্র। ভয়ংকর আসক্তি কিংবা অপব্যবহার যে কোনো বিষয়কে যে কোনো কিছুকেই বিপজ্জনক করে তোলে। সেটাই ঘটছে।
না, আমি প্রযুক্তি বা যন্ত্রবিরোধী নই। কথাগুলো বলার কারণ, দুদিন আগেই বিশ্ব পালন করল আত্মহনন বিরোধী এক দিবস। এমন একটা দিবস থাকাটাই মূলত ভয়ের। এমন দিবস না থাকলেই আনন্দ পেতাম। কিন্তু বাস্তবতা মানতেই হবে। জরিপে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে দিনে গড়ে ত্রিশজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সংখ্যাটা অনেকে জানেন না বলে হয়তো অনুদ্বিগ্ন থাকেন। চিন্তা করলেই মাথা খারাপ হওয়ার কথা। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলি বিদেশে বা উন্নত দেশ নামে পরিচিত সমাজে এই প্রবণতা আরও মারাত্মক। আমরা সবাই জানি জাপানিদের ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়ংকারভাবে বেশি। একটা সময় তারা তাদের জনসংখ্যার নিরাপত্তা নিয়েই ছিল আতংকিত। হারিকিরি নামে যে ভয়ানক বিষয় জাপানিরা তার শিকার। বনিবনা না হলে মন খারাপ হলে হতাশ হলে নিজের পেটে নিজে ছুরি চালিয়ে মারা যেত তারা। এমনও জানা যায়. কর্মস্থলে বা দেশের জন্য সবটা দিতে না পারার মতো গ্লানিতেও তারা হারিকিরি করে থাকে। কী ভয়ংকর!
মানুষের জীবন একটাই। ধর্ম বা শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মানব জীবন একটি সাধনার ফল। বলা হয়Ñ মানব জীবন সার/ এমন পাবে না আর/মিছে জীব কর না ক্রন্দন। সে যাই বলা হোক না কেন, মানুষ তারপরও জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ হলেই সে পথ বেছে নেয়। কেন নেয়? আমাদের বাঙালি জীবনে সমস্যার অন্ত নেই। দেশে সত্যিকারের সমস্যা অনেক। যেমনÑ যানজটের সমস্যা প্রকট। কিন্তু আপনি কি কখনো শুনেছেন এর জন্য কেউ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে? কখনো জেনেছেন দুর্নীতির বিরদ্ধে জীবন দিয়েছে কেউ? এত গভীর সমস্যার কারণে কেউ প্রাণ বিসর্জন না দিলেও সামান্য কারণে প্রাণ দেওয়ার বহু ঘটনা ঘটে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর জন্য দায়ী কারা? দায়ী কি শুধুই আত্মহননকারী?
নিঃসন্দেহে উত্তর হবে, না। যেমন ধরুন, প্রতিবছর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বের হলেই দেখা যায় কিছু ছাত্র-ছাত্রী নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে পরিণত হয় সংবাদে। এই করুণ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতি চলছে দীর্ঘকাল ধরে। এর যেন কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিকার হবে কি করে? এর জন্য মূলত দায়ী  তারা, যারা পাশে দাঁড়ালেই সমস্যার উদ্ভব হতো না। উল্টো তারা কি করে? আত্মহননকারীর আত্মীয়স্বজন, পরিবার কথা ও আচরণ দিয়ে এমন উত্ত্যক্ত করে যে, ভুক্তভোগীর জীবন ছেড়ে পালানোর পথ থাকে না। কোনো ছাত্র বা ছাত্রী যে কোনো একটি কাজে ব্যর্থ হতেই পারে। ফেল করাও স্বাভাবিক। দুনিয়ার বহু বিখ্যাত মানুষ সাকসেসফুল মানুষের জীবন শুরু হয়েছিল ফেল দিয়ে। তারা দুনিয়া জয় করার পরও এই ফেল বিষয়টার সমাধান হলো না। এর পাশাপাশি আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে, প্রেমে ব্যর্থতা।
প্রেমঘটিত আত্মহত্যার বিষয়টি এখন কমে যাওয়ার কথা। কারণ, ডিজিটাল মিডিয়ামের কারণে প্রেম এখন বহুমুখী। প্রগাঢ় গভীর আর নিবেদনমুখী প্রেম উধাও হওয়ার পথে। শুদ্ধতা বা নিবেদনের দিক থেকে বিষয়টা নিন্দনীয় হলেও এর সুফল অস্বীকার করবেন কি করে? বহুমুখীনতার কারণে মানুষ পছন্দ বা নির্বাচনে আবার সুযোগ লাভ করতে পারে। এটা ভালো কি মন্দ জানি না, তবে এর ফলে যৌবনের হতাশা কমেছে। হয়তো আত্মহত্যার হারও নেমে গেছে। তারপরও বলি, প্রেম কখনো বিবাহনির্ভর কিংবা মিলনে সম্পূর্ণ এমন কিছু নয়। বরং কাউকে ভালোবাসলে তার প্রতি সম্মান বা বিশ্বাস থাকলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে দেখানোই কাজের কাজ।
সংসারে অশান্তি, দাম্পত্যকলহ, অভাব অনটনের কারণেও মানুষ নিজের জীবন নিজে কেড়ে নেয়। মানসিক অবস্থা তখন এমন হয় যে, নিজেকে প্রবোধ দেওয়া যায় না। এ কারণে বিদেশে হটলাইনগুলো চব্বিশ ঘণ্টা চালু  থাকে। এরা যে কত শত লোকের প্রাণ বাঁচায় সেটা সত্যি বিস্ময়ের! জানি, এই হটলাইন আমাদের দেশেও আছে। হয়তো কাজও করে। কিন্তু এটা নিশ্চিত তা শতভাগ কাজ করে না। বা আত্মহননকারীরা সে লাইনে যায় না। কারণ, অবিশ্বাস ও সন্দেহ। এই সন্দেহ দূর করতে পারলে আত্মহননের হার কমবে।
উন্নত দেশেও সমাজে তরুণ-তরুণীরা এটুকু জানে হেল্পলাইন তাদের বাঁচাবে। যা বলবে যে ভরসা যে আশ্বাস দেবে তা পূরণ করবে। আমরা যদি সে রকম একটা ব্যবস্থা করতে পারি। তাহলে মঙ্গল। বাংলা-বাঙালি বড় সংবেদনশীল। এই সংবেদনশীলতা তাকে দেশে-বিদেশে সামাজিক ও আড্ডাবাজ করে রেখেছে। মানুষে মুক্তি, মানুষেই মঙ্গল। তাই রাজনীতি ধর্ম বা সম্প্রদায়ভিত্তিক ব্যবধানের বেড়া ভেঙে মানুষকে ভালোবাসলেই আমরা ভালো থাকব। ভালো থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

[email protected]

×