ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১

৬-জি নেটওয়ার্ক এবং ৬-জি ইন্টারনেট

ড. এম. মেসবাহ উদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫

৬-জি নেটওয়ার্ক এবং ৬-জি  ইন্টারনেট

সারাবিশ্বের প্রায় ৪৫০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বিবেচনায় শীর্ষ তিন দেশ হলো চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কিছু অঞ্চল/দেশ এখনো ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের বাইরে আছে। এর কারণ হলো, ঐসব অঞ্চলগুলো দুর্গম, পাহাড়ি কিংবা বিচ্ছিন্ন এলাকা। মোবাইল ইন্টারনেট ও আইএসপি, ফাইবার অপটিক ক্যাবল কিংবা স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোনোটাই এই অঞ্চলগুলোতে স্থাপন করা সহজ নয়। ৩-জি, ৪-জি ইন্টারনেটের পর এখন চলছে ৫-জি ইন্টারনেটের সম্প্রসারণ। যদিও এরই মধ্যে ইলন মাস্কের স্টারলিংক ইন্টারনেট ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলে ফেলেছে। কিন্তু সেই ঝড়কেও টেক্কা দিয়ে আরও দ্রুতগতির ইন্টারনেট ছেড়েছে চীনের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গিস্পেস। নাম ৬-জি ইন্টারনেট। প্রতিষ্ঠানটির নির্মাতা চ্যাং গুয়াং এর দাবি, তাদের স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ গিগাবাইট ডেটা স্থানান্তর করতে সক্ষম ৬-জি। ইলন মাস্কের স্টারলিংক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মূলত আন্তঃস্যাটেলাইট যোগাযোগ পরিচালনা করে থাকে এবং এই প্রযুক্তি স্যাটেলাইট থেকে গ্রাউন্ড যোগাযোগে এখনো সফল হয়নি। কিন্তু চীনের তৈরি ৬-জি ফিল্ড টেস্ট নেটওয়ার্ক অর্থাৎ গ্রাউন্ড যোগাযোগে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। এটি ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩০০ থেকে দুই হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় সিগন্যাল পিক করতে পারছে। ৬-জি’র গতি প্রতিসেকেন্ডে ১ টেরাবাইট যা ৫-জি’র চেয়ে ৮ হাজার গুণ বেশি। গিস্পেস এ পর্যন্ত ৩০টি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে এবং বিশ্বের ৯০ শতাংশ এলাকায় সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সেবা দিয়ে যাচ্ছে ৬-জি। সস্তা হওয়ার কারণে এসব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দ্রুত ইন্টারনেট সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২-জি নেটওয়ার্ক ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করে। ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে ৩-জি চালু হয়। তারপর ২০০৯ সালে ৪-জি এসে পুরো ধারণা বদলে দেয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ৫-জি নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু হয়। এখনো ৫-জি নেটওয়ার্কের তেমন বিস্তৃতি ঘটেনি। তবে খুশির বিষয় হচ্ছে যে, মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির আগের সকল অভিজ্ঞতাকে ভুলিয়ে দিতেই যেন আসছে ৬-জি। যেমন: ১. অবিশ্বাস্য গতি: ৬-জি নেটওয়ার্কের গতি ৫-জি এর চেয়ে কয়েকগুণ দ্রুত। এটি একটি তাৎক্ষণিক গিগাবাইট ডেটা ডাউনলোড করার অনুমতি দেবে, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে অন্যান্য ডিভাইসগুলোর জন্য নতুন সম্ভাবনার সূচনা করবে। ২. কম লেটেন্সি: ৬-জি’তে প্রায় শূন্য লেটেন্সি বা ডেটা ল্যাগ থাকবে। এটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর), অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) এবং গেমিংয়ের মতো ক্ষেত্রে আরও নিখুঁত এবং দ্রুত অভিজ্ঞতা প্রদান করবে। ৩. নতুন প্রযুক্তির জন্য সম্ভাবনা: ৬-জি স্বায়ত্তশাসিত গাড়ি, স্মার্ট শহর এবং ইন্টারনেট অব থিংস (ওড়ঞ) এর পরিসরকে আরও প্রসারিত করবে। এটি এআই এবং মেশিন লার্নিংকে একটি নতুন স্তরে নিয়ে যাবে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভরতা তৈরি করবে। ৪. গ্লোবাল কানেক্টিভিটি: ৬-জি নেটওয়ার্কের সাহায্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উচ্চগতির ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছানো সম্ভব হবে। যা ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ৫. ব্রডব্যান্ড সম্প্রসারণ: ৬-জি প্রযুক্তি শুধু ব্যক্তিগত ব্যবহারকারীদের জন্য নয়, বিভিন্ন শিল্পে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগকে প্রসারিত করবে। শিল্প, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা উন্নত ব্রডব্যান্ড পরিষেবা নিশ্চিত করবে, যা কাজের গতি ও দক্ষতা বাড়াবে। ৬. অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা : ৬-জি নেটওয়ার্কে নতুন প্রজন্মের সাইবার নিরাপত্তা টুলস ব্যবহার করা যাবে, যা ডেটা চুরি বা হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। এছাড়া এআই-ভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে হুমকি শনাক্ত করতে সক্ষম হবে। ৭. অত্যন্ত দ্রুত প্রতিক্রিয়া: ৬-জি প্রযুক্তির সঙ্গে সিস্টেমের প্রতিক্রিয়ার সময় অত্যন্ত কম হবে। এটি বিশেষত দূরবর্তী সার্জারি বা রোবটিক নিয়ন্ত্রণের মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিপ্লব ঘটাবে, যেখানে স্বল্প বিলম্বও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে স্যাটেলাইট নির্ভর লেসার যোগাযোগ সংবলিত স্টারলিংক কিংবা চীনের ৬-জি ইন্টারনেট সেবা চালু হওয়ার ফলে প্রচলিত টেলিকম কোম্পানিগুলো অনেকটা হুমকির মুখে পড়বে। কেননা, একটি টাওয়ারের চেয়ে একটি স্যাটেলাইট বিভিন্ন প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করে অতি দ্রুত এবং কম খরচে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। অন্য অসুবিধাগুলো হলো : ১. উচ্চ খরচ: নতুন প্রজন্মের নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য অনেক খরচ হবে। গ্রাহক এবং পরিষেবা প্রদানকারীদের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ডিভাইস আপগ্রেডের জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হবে। ২. গোপনীয়তার ঝুঁকি: বৃহত্তর সংযোগ এবং দ্রুত তথ্য বিনিময় সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ৬-জি’এর সঙ্গে, আরও সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদান করা হবে, যা হ্যাকিং এবং ডেটা ফাঁসের ঝুঁকি বাড়াবে। ৩. বর্ধিত শক্তি খরচ: ৬-জি নেটওয়ার্কগুলো পরিচালনা করতে অনেক বেশি শক্তির প্রয়োজন হবে। এটি পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ৪. স্বাস্থ্যের প্রভাব: উচ্চ গতির ইন্টারনেটের জন্য ব্যবহৃত ফ্রিকোয়েন্সিগুলো স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ৫. গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন চ্যালেঞ্জ: ৬-জি প্রযুক্তির জন্য একটি একক বৈশ্বিক মান নির্ধারণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ৬. নতুন ডিভাইস প্রয়োজন: ৬-জি নেটওয়ার্ক সমর্থন করার জন্য পুরনো ডিভাইসগুলো অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। ৭. প্রশিক্ষণের অভাব : যখন ৬-জি চালু করা হবে তখন এর ব্যবহারে যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে।
বর্তমানে গিস্পেসেস এর অধীনে ১১৭টি কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে। পরবর্তী প্রকল্পের প্রথম ধাপে তারা ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সারাবিশ্বে ইন্টারনেট সেবা দিতে ৭২টি উপগ্রহ কক্ষপথে পাঠাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে মোবাইল ফোন যোগাযোগের জন্য ২৬৪টি স্যাটেলাইট পাঠাবে প্রতিষ্ঠানটি। তৃতীয় ধাপে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ডের জন্য পাঠানো হবে পাঁচ হাজার ৬৭৬টি স্যাটেলাইট। এভাবে ২০২৭ সালের মধ্যে ৩০০ স্যাটেলাইটের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক বিশ্বের ৯০ শতাংশ এলাকায় সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সেবা দিতে পারে। তাদের স্যাটেলাইট ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ থেকে দুই হাজার কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত কাজ করেছে। সস্তা হওয়ার কারণে এসব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দ্রুত ইন্টারনেট সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। পক্ষান্তরে, স্টারলিংক বর্তমানে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সারাবিশ্বে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। উল্লেখ্য, গিস্পেস ২০২২ সালে তাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে। গিস্পেস সব মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার স্যাটেলাইটের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। আর তাই স্টারলিংকের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে গিস্পেসকেই।
গিস্পেসের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি চীনা প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর জন্য কাজ করছে। গত আগস্টে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ সাংহাই স্পেসকম স্যাটেলাইট টেকনোলজি তাইওয়ান থেকেও একাধিক স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। সেই নেটওয়ার্ক জি৬০ স্টারলিংক প্ল্যান নামেও পরিচিত। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ বছর ১০৮টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে সংস্থাটি। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ৬৪৮টি উপগ্রহ ও ২০৩০ সালের আগে ১৫ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে এ চীনা সংস্থাটির। এদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ২০২৬ সালে ৬-জি নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি উন্মোচন করার ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশটির বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ‘কে-নেটওয়ার্ক ২০৩০’ কৌশল নামে একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। প্রযুক্তিগত প্রদর্শনীটি পরিচালনার জন্য কোরিয়া সরকার একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। প্রাথমিকভাবে প্রদর্শনীটির নামকরণ হয়েছে ‘৬-জি ভিশন ফেস্ট’। বর্তমানে দেশটি ৪৮ কোটি ২৭ লাখ ডলার ব্যয়ের জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করছে। অনুমোদনের পর এ প্রকল্পগুলোয় বাণিজ্যিকীকরণের জন্য ৬-জি প্রযুক্তি, ওপেন রেডিও অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক এবং সংশ্লিষ্ট উপাদান, যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কে-২০৩০ নেটওয়ার্ক কৌশল অনুসারে, কোরিয়া ২০২৭ সালে অ্যান্টেনা ও মডেমের কোর প্রযুক্তি পরীক্ষার জন্য পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট চালু করবে। ২০৩০ সালের পর প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নিম্ন কক্ষপথে যোগাযোগ ব্যবহার শুরু হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×